হয়রানির ভয় তো নেই-ই, বরং সুবিধার আশ্বাস। আর সে জন্য বিশ্বাসের হাত বাড়ানো। বিশ্বাসভঙ্গ করলে কঠোর পদক্ষেপের হুঁশিয়ারিও।
মূল্যযুক্ত কর (ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্স, সংক্ষেপে ভ্যাট) আদায়ে তথ্যপ্রযুক্তি-নির্ভর অনলাইন প্রক্রিয়া চালু করার সময়ে গত বছর এমনই নীতি ঘোষণা করেছিল পশ্চিমবঙ্গের অর্থ দফতর। বছর ঘুরতেই তার ফল মিলতে শুরু করেছে বলে সরকারের দাবি। অর্থ দফতরের তথ্যেও তার সমর্থন। দফতরের হিসেব বলছে, রাজ্যের সিংহভাগ ব্যবসায়ী ‘সরকারি বিশ্বাস’-এর মর্যাদা দিয়ে সরলীকৃত ব্যবস্থায় অনলাইনে ভ্যাট জমা দিতে শুরু করেছেন।
ফলে চলতি অর্থবর্ষে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ বেড়েছে অনেকটা। উল্টো দিকে, বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে কর ফাঁকি দিয়েছেন যাঁরা, তাঁদের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ায় অনাদায়ী কর ও জরিমানা আদায় বৃদ্ধি পেয়েছে। “কর ব্যবস্থায় সংস্কার দু’দিক দিয়ে লাভজনক হয়েছে। কর জমার হার বাড়ায় আয় বাড়ছে, আবার ফাঁকি দিলে অনাদায়ী করের সঙ্গে আদায় হচ্ছে জরিমানা। কেউ যথাযথ কর জমা করছেন নাকি ফাঁকি দিচ্ছেন, আইটি’র দৌলতে চটজলদি ধরে ফেলা যাচ্ছে।” বলেন অর্থ দফতরের এক কর্তা। তাঁর বক্তব্য: ব্যবসায়ীরা নিজের কর অনলাইনে মিটিয়ে দেওয়ায় কর-আধিকারিকদের হাতে ‘হয়রানি’র প্রশ্ন থাকছে না। এতে ব্যবস্থাটির উপরে ব্যবসায়ীদের আস্থা ও বিশ্বাস বাড়ছে। তবে যাঁরা ঠিকঠাক ভ্যাট দিচ্ছেন না, তাঁদের ক্ষেত্রে আধিকারিকদের ‘অতি সক্রিয়’ হতে বলা হয়েছে।
এবং এই সূত্রেই জোরদার করা হয়েছে কর-শাসনের পরিকাঠামো। অর্থ-সূত্রের খবর: কর ফাঁকি ঠেকাতে ১৯৭০-এ অর্থ দফতরের অধীনে তৈরি হয়েছিল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন (বিওআই)। কিন্তু পরবর্তী সাড়ে তিন দশকে বছরে তার দিকে সে ভাবে নজর দেওয়া হয়নি। বিআইও অফিসারদের কলকাতায় একটা অফিসে বসেই সারা রাজ্য সামলাতে হচ্ছিল। এতে বহু ব্যবসায়ী কর না-দিয়েও রেহাই পেয়ে যাচ্ছিলেন। এ বার ব্যুরোটিকে বিভিন্ন অঞ্চলের জন্য আলাদা আলাদা ভাগে ভাগ করে দেওয়ার পাশাপাশি তার হাতও শক্তিশালী করা হয়েছে। কী রকম?
রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র বলেন, “বিওআই-কে তিনটে ভাগে ভেঙে দেওয়া হয়েছে। একটা খাস কলকাতার জন্য। দক্ষিণবঙ্গ ও উত্তরবঙ্গের জন্য আলাদা দু’টো। সেই সঙ্গে গড়া হয়েছে ডেটা অ্যানালিসিস উইং (ডিএডব্লিউ), যার বিশেষজ্ঞেরা তথ্য-প্রযুক্তির সাহায্যে কর ফাঁকির নানা তথ্য বিআইও অফিসারদের পাঠাচ্ছেন। শুরু হচ্ছে তদন্ত।” পরিণামে সরকারের ঘরে দ্রুত উঠে আসছে অনাদায়ী কর, সঙ্গে বাড়তি জরিমানা বাবদ মোটা টাকা। নতুন ব্যবস্থার সুবাদে চলতি অর্থবর্ষে এরই মধ্যে ১১৩ কোটি টাকার ভ্যাট ফাঁকি ধরা পড়েছে বলে জানান অমিতবাবু। ব্যবস্থাটি কাজ করছে কী ভাবে?
ডিএডব্লিউ-র এক কর্তা জানাচ্ছেন, ভ্যাট নম্বর অনেকটা প্যান নম্বরের মতো। প্যান নম্বর মারফত যেমন কারও রোজগারের বিবিধ উৎস, প্রদেয় কর কিংবা ব্যাঙ্কিং আদান-প্রদানের যাবতীয় তথ্য পাওয়া যায়, তেমন ভ্যাট নম্বর থেকেও জানা যায় সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীর ক্রয়-বিক্রয়, ওয়েবিল বা প্রদেয় ভ্যাটের অঙ্ক। প্রথমে ভ্যাট নম্বর ধরে ধরে সন্দেহজনক আদান-প্রদান বাছাই করা হয়। তার পরে সেগুলো নিয়ে কর-আধিকারিকেরা বিশদ তদন্তে নামেন। তদন্তের ফলাফল অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়। পুরোটাই সম্ভব হচ্ছে তথ্য-প্রযুক্তির দৌলতে।
ই-করের এ হেন সুশাসন এক বছরের মধ্যে সাফল্যের সঙ্গে বলবৎ হওয়ায় অর্থমন্ত্রীও বিলক্ষণ খুশি। “বাম জমানায় ভ্যাট আদায় প্রক্রিয়ায় নানাবিধ গলদ ছিল। অস্বচ্ছতা ছিল। অনলাইনে কর জমার সুযোগ থাকলেও পদ্ধতি ছিল বেশ জটিল। এখন তা সরল করে দেওয়া হয়েছে। তাতেই রোজগারের পথ খুলে গিয়েছে।” মন্তব্য অমিতবাবুর। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের অর্থমন্ত্রীর আরও দাবি, “ব্যবসায়ীদের উপরে
বিশ্বাস রেখে আমরা যে ভুল করিনি, এ তারই প্রমাণ। অনলাইনে ভ্যাট (ই-সহজ) এবং ওয়েবিল (ই-ওয়ে) জমা চালু হয়েছে। ব্যবসায়ীরা নিজেরাই ঘোষণা করছেন প্রদেয় করের পরিমাণ। সেই মতো সরকারি তহবিলে জমা করে দিচ্ছেন। শুধু তা-ই নয়, যাঁদের বার্ষিক টার্নওভার পাঁচ কোটির মধ্যে, তাঁরা হিসেব পেশের (সেল্ফ অডিট) ব্যাপারে পূর্ণ স্বাধীনতা পাচ্ছেন। অন্যদের ক্ষেত্রেও হিসেব যাচাইয়ের পদ্ধতি সরল হয়েছে।”
এ সবের সম্মিলিত প্রভাবে রাজস্ব আদায় যেমন ঊর্ধ্বমুখী, তেমন কর-আধিকারিকদের বিরুদ্ধে অভিযোগের বহরও লক্ষ্যণীয় ভাবে কমে গিয়েছে বলে অর্থমন্ত্রীর পর্যবেক্ষণ। “কর আদায়ে ইন্সপেক্টর-রাজ খতম করে স্বচ্ছ-সরল ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফল মিলতে শুরু করেছে।” বলছেন তিনি। |