এলাকায় সেচের সুবিধা নেই। ধান রোয়ার সময়ে (জুন-জুলাইয়ে) পর্যাপ্ত বৃষ্টি হয়নি। শ্যালো-পাম্প বা ডিপ টিউবওয়েল ব্যবহার করার ক্ষমতা নেই। কিন্তু এ বার ধানের ফলন নিয়ে মুখে হাসি ধরছে না চাষি-দম্পতি সুফল এবং রেবতী মুর্মুর। গত দু’বার একই অবস্থায় চাষ করে ধানের বদলে জুটেছিল খড়। এ বার তিন বিঘা জমিতে চাষ করে সুফল আর রেবতী ধান পেয়েছেন প্রায় ১১ কুইন্টাল। হাসি তো ফুটবেই।
আদিবাসী গ্রাম আসানসুলি। দুবরাজপুর ব্লক। বীরভূম জেলা। স্থানীয় বাসিন্দা সুফল-রেবতীই নন, গোঁসাই হেমব্রম, নেপাল হেমব্রম, রঘুনাথ মুর্মুদের মতো বেশ কিছু কৃষক ধান চাষ করে গড়ে বিঘা-প্রতি সাড়ে তিন-পাঁচ কুইন্টাল ফলন পেয়েছেন।
রহস্যটা কী?
চাষিরা জানাচ্ছেন, রহস্য ধানের বীজে। কেন্দ্রীয় সরকারের ‘জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা অভিযান কর্মসূচি’-র তরফে তাঁদের বিনামূল্যে সরবরাহ করা হয়েছিল খরা সহনশীল প্রজাতি হিসেবে পরিচিত সহবাগি ধান। বিশেষজ্ঞদের মতে, মাটি থেকে রস টানার ক্ষমতা বেশি এই ধানের। এর সঙ্গে এই এলাকার কৃষকেরা আগে পরিচিত ছিলেন না। প্রথাগত ভাবে তাঁরা চাষ করতেন লাল স্বর্ণ। গোঁসাই হেমব্রমের কথায়, “গত দু’বছর স্বর্ণ জাত চাষ করি। এ বছরের মতোই বৃষ্টি কম হয়েছিল। কিন্তু পর পর দু’বছর পুরো ফসলটাই মার খেয়েছিল।”
কৃষি-বিশেষজ্ঞদের মতে, বীরভূমের এই এলাকার মাটিতে অম্লের ভাগ বেশি, তাই উর্বরতা কম। তা ছাড়া, বর্ষায় বৃষ্টিরও দেখা ছিল না। দক্ষিণবঙ্গে এ বার স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টি হলেও বীরভূম জেলা অনেকটাই পিছিয়ে ছিল। জুন ও জুলাই, ধান রোয়ার প্রধান সময় এই দুটো মাসে প্রত্যাশিত বৃষ্টির চাইতে অনেকটাই ঘাটতি ছিল বৃষ্টিতে।
এই পরিস্থিতিতে চাষিদের বাঁচিয়েছে ‘সহবাগি’। কেন্দ্রীয় প্রকল্প কার্যকর করার দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা ‘ইন্টারন্যাশনাল রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউট’ (ইরি) আসানসুলি গ্রামের ১০০ হেক্টর জমিকে পরীক্ষামূলক ভাবে বেছে নিয়েছিল। গ্রামের ৮০ জন কৃষককে তাঁদের জমির পরিমাণ অনুযায়ী দেওয়া হয়েছিল মোট পাঁচ টন তিনশো কেজি বীজ। কর্মসূচির স্থানীয় পরামর্শদাতা ও কৃষি বিশেষজ্ঞ সুবীর চৌধুরী জানান, পর পর দু’বছর আসানসুলি গ্রামের কৃষকেরা ফলন পাননি। সে জন্যই আসানসুলি গ্রামকে বাছার চ্যালেঞ্জ নেওয়া হয়। তিনি বলেন, “এ বছরও চাষের সময়ে মাটি ফেটে গিয়েছিল। শুধু পুজোর আগে বৃষ্টির মুখ দেখেছিলেন কৃষকেরা। প্রকৃতির সহায়তা বলতে ওইটুকুই।”
স্থানীয় কৃষিজীবীরা জানান, পরিবেশ-পরিস্থিতি ঠিক থাকলে স্বর্ণ ধান চাষ করে তাঁরা বিঘা প্রতি এক থেকে দেড় কুইন্টাল ফলন পান। এ বার পেয়েছেন তিন কুইন্টাল। ‘ইরি’ স্থানীয় যে সংস্থাকে ওই কর্মসূচির দায়িত্ব দিয়েছে, তার কৃষি তত্ত্বাবধায়ক পরিমল বসুর অবশ্য বক্তব্য, “বিঘা প্রতি সাড়ে তিন কুইন্টাল ফলন খুব বেশি নয়। কিন্তু আগে পরপর দু’বছর চাষিরা কিছুই পাননি। তাই এই ফলন তাঁদের কাছে অনেক।”
রাজ্যের ধান বিশেষজ্ঞ ও চুঁচুড়া ধান গবেষণাকেন্দ্রের কৃষিবিজ্ঞানী বিজন অধিকারী জানান, এর আগে বাঁকুড়ার খরাপ্রবণ এলাকাতেও সহবাগির চাষ করে সুফল মিলেছে। পশ্চিমবঙ্গে খরিফ মরসুমে ধান চাষের ৪৫ লক্ষ হেক্টর জমির মধ্যে প্রায় পাঁচ লক্ষ হেক্টরই খরাপ্রবণ। সেখানে এই ধানের চাষ ব্যাপক ভাবে হলে ধানের সামগ্রিক ফলনও বাড়বে। বিজনবাবুর দাবি, “টানা প্রায় দু’সপ্তাহ অনাবৃষ্টি সহ্য করতে পারে সহবাগি ধান। খরা পরিস্থিতিতেও তাই ভাল ফলন পাওয়া যায়।” তাঁর সংযোজন, “বীরভূমের আবহাওয়া এ বার ধান চাষের পক্ষে প্রতিকূল ছিল। দুবরাজপুরের ওই গ্রামে সহবাগি ধানের সফল চাষ এ ক্ষেত্রে নজির বলা যেতে পারে।”
সহবাগি ধানের পরীক্ষামূলক চাষে রাজ্য কৃষি দফতরও আশার আলো দেখছে। দফতরের বীরভূম জেলার সহ-অধিকর্তা প্রদীপ মণ্ডল বলেন, “নতুন জাতের ধান চাষ করে ৮০ শতাংশেরও বেশি ফলন হয়ে। স্বর্ণ জাত চাষ করলে যেটা বড়জোর ৪০ শতাংশ হত।” তিনি জানান, এ বছর ওই গ্রাম থেকে প্রায় ১০ টন সহবাগি ধানের বীজ সংগ্রহ করার লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে, যাতে আরও বেশি খরাপ্রবণ এলাকায় এই ধানের চাষ করা যায়। |