পুস্তক পরিচয় ১...
নিজের দুর্বলতা নিয়ে কুণ্ঠাহীন
উজান গাঙ বাইয়া। হেমাঙ্গ বিশ্বাস। অনুষ্টুপ, ৫০০.০০
হেমাঙ্গ বিশ্বাস রচনাসংগ্রহ ১। দে’জ, ৬৫০.০০
জীবনের উপান্তে এক সাক্ষাত্‌কারে কিছুটা ক্ষোভে-অভিমানেই জানাচ্ছিলেন তিনি: ‘...আমি একা ফাইট কইর্যা যামু।...আমি মানুষরে বিশ্বাস করি...’—হ্যাঁ, গণসংগীত রচয়িতা, শিল্পী-তাত্ত্বিক-ভাবুক হেমাঙ্গ বিশ্বাস (১৯১২-১৯৮৭) আমৃত্যু স্থিতধী ছিলেন বামপন্থী চিন্তাধারায়, ছিলেন আপসহীন এক সংগীত-যোদ্ধা। তাঁর জীবন ও সংগীতকৃতির সঙ্গে ওতপ্রোত হয়ে আছে বামপন্থী রাজনীতি। মার্কসবাদী ভাবধারায় গড়ে-ওঠা জীবনবোধের প্রতিফলন তাঁর সমগ্র সৃষ্টিতে—সে গান-ই হোক বা প্রবন্ধ। নিজের জীবনও কম বৈচিত্রময় নয় তারই শুরুর দিকটা প্রথমে পত্রিকায়, পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত উজান গাঙ বাইয়া (১৩৯৬)। জন্মশতবর্ষে তা নবরূপ পেল মৈনাক বিশ্বাসের সম্পাদনায়। আর সম্প্রতি বেরোল হেমাঙ্গ বিশ্বাস রচনাসংগ্রহ ১। এ বইয়ে প্রণব বিশ্বাস ও রঙিলী বিশ্বাসের ভূমিকা পড়ে বোঝা যায় সম্পাদনা তাঁদেরই। সুসম্পাদিত এই দু’টি গ্রন্থে নিশ্চিত ভাবেই ধরা পড়ে সৃষ্টিশীল এক মানুষের জীবন ও সৃজন।
উজান গাঙ বাইয়া-র শতবার্ষিক সংস্করণে জীবনকথার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কিছু প্রবন্ধ, চিঠিপত্র, সাক্ষাত্‌কার। জমিদার-তনয় হেমাঙ্গের স্মৃতিকথনে সহজে উঠে এসেছে জন্মস্থান মিরাশী গ্রাম, সেখানকার মানুষজন, প্রকৃতি, মাতামহ তবলিয়া রাজকুমার চৌধুরি, ভিক্ষে-চাওয়া মৌলবির গান, মুকুন্দদাসের যাত্রা, কবিগান। স্বদেশি আন্দোলনে যোগ দেওয়ায় কারাবরণ করতে হয় দু’বার। যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে কলকাতায় আসেন চিকিত্‌সার জন্য। অনিলেন্দু রায় ও সিলেটের দু-এক জন কমিউনিস্টের সাহচর্যে মার্কসবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাড়ি ফেরেন। কিছু দিনের মধ্যেই রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে বাড়ি থেকে বিতাড়িত হন। নিশ্চিন্ত আশ্রয় ছেড়ে নির্দ্বিধায় বেরিয়ে পড়েন অজানিতের পথে। সিলেট কমিউনিস্ট পার্টি, গণনাট্য সংঘ, সুরমা কালচারাল স্কোয়াড ও আসাম গণনাট্য সংঘ আর গান রচনা: এ সবের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলে তাঁর জীবন।
তাঁর প্রধান অস্ত্র গান। ‘আমার গান আমার একার সৃষ্টি নয়, একটা আন্দোলনের সৃষ্টি’, বলছেন তিনি। এখানে আন্দোলন বলতে গণনাট্য আন্দোলন। এর মধ্য দিয়েই তাঁর ও সমসময়ের আরও কয়েক জনের গান সাধারণ্যে প্রসারিত হলেও হেমাঙ্গ তার আগেই লিখেছিলেন বিখ্যাত ‘কাস্তেটারে দিও জোরে শান’—যা কৃষকদের মধ্যে সহজে ছড়িয়ে পড়েছিল। তাঁর গান প্রচারমাধ্যমের সহায়তা ছাড়াই সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছতে পেরেছিল, কেননা তাদের দুঃখ-দুর্দশা, প্রতিবাদ-প্রতিরোধের কথা সহজ ভাবে গানে তুলে ধরেছিলেন, সঙ্গে সুরও সুসমঞ্জস। লোকায়ত সুরের ব্যবহারই বেশি, তবে উচ্চাঙ্গসংগীতও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে কাজে লাগিয়েছেন। তিনি সঠিক ভাবেই মনে করতেন যে, লোকসংগীত আর উচ্চাঙ্গসংগীতের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক আছে।
তাঁর গানের তিনটি সংকলনগ্রন্থ—বিষাণ (দ্বিতীয় সং, ১৯৪৪), শঙ্খচিলের গান (১৯৭৫), হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গান (১৯৮০) এবং একমাত্র কবিতা-সংকলন সীমান্ত প্রহরী (১৯৬১) বিস্তারিত টীকা-তথ্য সমেত স্থান পেয়েছে রচনাসংগ্রহ ১-এ। সলিল চৌধুরি, বিনয় রায় প্রমুখ রচয়িতার কিছু গানও তাঁর সংগীতগ্রন্থে আছে। সব গানের সুরও তাঁর নিজের নয়। সে-সব স্বীকৃতিও এখানে যথাযথ ভাবে আছে।
সংগীত রচনার পাশাপাশি সংগীতশিল্পী হিসেবেও তিনি সার্থক, যদিও রেকর্ড বা ক্যাসেট সামান্যই, তাও শেষ দিকে। গান নিছক উপভোগ্যতা ছাড়িয়ে যে সমাজের কাজেও লাগতে পারে, তারই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ‘হারাধন রঙমন কথা’। ১৯৬০-এ অসমে ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গার প্রেক্ষিতে তিনি ও ভূপেন হজারিকা এটি রচনা করে সারা অসমে গেয়ে বেড়িয়েছিলেন।
আলোচ্য দু’টি গ্রন্থেই স্থান পেয়েছে হেমাঙ্গের বেশ কিছু সংগীত ও গণনাট্য সম্পৃক্ত নিবন্ধ, যা চেনায় এক নিপুণ বিশ্লেষককে, এক নির্মম সমালোচককে, যিনি নিজের দুর্বলতা প্রকাশেও কুণ্ঠাহীন। যেমন, ‘গণনাট্য ও আত্মকথা’ নিবন্ধে তাঁর স্বীকারোক্তি: ‘...আমাদের তখনকার গানগুলিতে কাব্যগুণের যথেষ্টই অভাব ছিল।’ তখন বলতে প্রথম দিকে। ‘এক্ষণ’, ‘সাহিত্যপত্র’, ‘প্রস্তুতিপর্ব’ প্রভৃতি পত্রিকায় লিখেছেন নিবন্ধ, ‘বসুমতী’ পত্রিকায় নিয়মিত কলাম ‘মুর্শিদ’ ছদ্মনামে। তাঁর বক্তব্যগুলি স্পষ্ট: লোকসংগীতের প্রধান বৈশিষ্ট্য আঞ্চলিকতা, হেমাঙ্গ যার নাম দিয়েছিলেন ‘বাহিরানা’। লোকসংগীত পরিবেশনে এই আঞ্চলিকতা অবশ্যই বজায় রাখতে হবে। লোকজীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাও দরকার। কিন্তু তিনি ব্যথিতচিত্তে লক্ষ করেছেন যে, অনুষ্ঠানে-রেডিয়োয়-রেকর্ডে লোকগান বিকৃত ভাবে গাওয়া হচ্ছে। এর প্রতিবাদে তিনি সর্বদাই সরব, আক্রমণাত্মক। এই বিকৃতির উত্‌স, তাঁর মতে, বাণিজ্যিকতা আর গণজীবন থেকে নাগরিক মানুষের বিচ্ছিন্নতা। যাঁর ‘দেরাজী ও দরদী কণ্ঠেই’ হেমাঙ্গর গান প্রথম প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিল, যিনি হেমাঙ্গকে সুরযোজনাতেও সাহায্য করেছিলেন সেই নির্মলেন্দু চৌধুরীর কোনও কোনও গানেরও হেমাঙ্গ সমালোচনা করেছেন। গণনাট্য সংঘের সঙ্গে তাঁর গোড়া থেকেই নিবিড় যোগ। যার আন্দোলনে লোকশিল্প চর্চার একটা ব্যাপ্ত পরিসর তৈরি হয়েছিল, সেই সংঘই তিনি দেখলেন ক্রমশ পথভ্রষ্ট হল।
তাঁর কথানুযায়ী: ‘গণনাট্য সংঘ-এ talent-এর অভাব নেই, অভাব সঠিক রাজনৈতিক নেতৃত্বের।’ তাঁর মনে হয়েছিল: ‘...একদিকে অতিবামপন্থী হঠকারিতা যা শেষ পর্যন্ত গিয়ে দাঁড়াল মূর্তিভাঙার চরম নেতিবাচক পন্থায়, অন্যদিকে নাট্য আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের আত্মসমর্পণ এই দুয়ে মিলে সংস্কৃতি আন্দোলনের সর্বনাশ হল।’ আবার জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রর ‘নবজীবনের গান’কে অসাধারণ সৃষ্টি বলেও তিনি প্রশ্ন তোলেন: ‘এর রাজনৈতিক বিষয়বস্তুটা কী’ (‘গণনাট্য আন্দোলনে আমার গান’)।
গণনাট্য সংঘ বা বামফ্রন্ট সরকার এক সময় তাঁকে কিছুটা বর্জন করেছিল, যদিও ১৯৮০-তে গণনাট্য উত্‌সবে তিনি আমন্ত্রণ পান। কিন্তু যাননি এ বিষয়ে তত্‌কালীন তথ্য-সংস্কৃতি মন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে চিঠিতে তাঁর সঙ্গত ক্ষোভের কথা জানিয়েছিলেন। হেমাঙ্গ সুরকৃত উত্‌পল দত্তের ‘কল্লোল’-এর ব্যাপারেও গণনাট্য সংঘের ভূমিকা দুঃখজনক। এতদ্সত্ত্বেও দেবব্রত বিশ্বাস বা অন্য কারও কারও মতো হেমাঙ্গ গণনাট্য সংঘ সম্পর্কে নিস্পৃহ হয়ে পড়েননি। তাঁর ‘গণনাট্য আন্দোলন ও লোকসংগীত’ প্রথমে ‘এক্ষণ’-এ, পরে লোকসংগীত সমীক্ষা বাংলা ও আসাম গ্রন্থভুক্ত হয় এই পাঠটিই রচনাসংগ্রহ ১-এ গৃহীত। কিন্তু, লোকসংগীত সমীক্ষা বাংলা ও আসাম-এর পরিমার্জিত রূপ গানের বাহিরানা (১৯৯৮) গ্রন্থে প্রবন্ধটির পাঠ একটু আলাদা। দেবব্রত, ঋত্বিক, মঘাই ওঝা, নিবারণ পণ্ডিত সম্পর্কে হেমাঙ্গের লেখাগুলি সুচিন্তিত।
উজান গাঙ বাইয়া-তে প্রকাশিত চিঠিপত্র আগ্রহসঞ্চারী। যে মাও জে দং-এর নেতৃত্বে জেগে উঠেছিল চিন, সেই মাওয়েরই বিরোধিতা শুরু হল একদিন সেখানে। আশির দশকে বন্ধু রাজনীতিক লিন হুয়া শিয়ান ও সিপিসি-র কেন্দ্রীয় কমিটিকে লেখা হেমাঙ্গর দু’টি চিঠি এ প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর মৃত্যুর পর নানা দেশে সমাজতন্ত্র বিপন্ন হয়। বেঁচে থাকলে দেখে মর্মাহত হতেন, তবে নিজস্ব রাজনৈতিক বিশ্বাসের প্রতি সংশয়াতীত সততা ও নিষ্ঠার জোরে হয়তো এই মানসিক সংকট থেকে উত্তরণের পথও খুঁজে নিতেন। তাঁর মতো নির্লোভ, বাণিজ্যিকতার পিছনে না-ছোটা মানুষ আজকের দিনে দুর্লভ। আমরা সাগ্রহে রচনাসংগ্রহ-২-এর অপেক্ষায় রইলাম।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.