জামাতে ইসলামির নেতা কাদের মোল্লার ফাঁসি অগ্নিগর্ভ বাংলাদেশকে আরও উত্তাল করিয়াছে। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যা ও গণধর্ষণের মতো ‘যুদ্ধাপরাধে’ অভিযুক্ত কাদেরের মৃত্যুদণ্ড একেবারে শেষ মুহূর্তে সুপ্রিম কোর্ট সাময়িক ভাবে স্থগিত করায় বিরোধী শিবিরে যে আশাবাদ জাগ্রত হয়, ফাঁসির আদেশ বহাল থাকায় তাহা ধসিয়া পড়ে। হাসিনা ওয়াজেদের আওয়ামি লিগ সরকার আর কালবিলম্ব না করিয়া মৃত্যুদণ্ড কার্যকরও করিয়া ফেলে। জামাতে ইসলামি স্বভাবতই প্রতিশোধের ডাক দিয়াছে। মুখে সেই প্রতিশোধ ‘ইসলামকে গভীরতর করার মধ্য দিয়া অর্জন’-এর কথা বলিলেও কার্যত ব্যাপক হিংসা, হানাহানি ও রক্তপাতের মধ্য দিয়াই তাহা গৃহীত হইতেছে। বাংলাদেশের রাস্তা জুড়িয়া পুলিশ ও নিরাপত্তারক্ষীদের সহিত বিরোধী দলের সমর্থকদের সংঘর্ষ, গুলিবিনিময় চলিতেছে। পথে দগ্ধ যানবাহনের কঙ্কাল, পোড়া দোকানঘরের লুণ্ঠিত সামগ্রী, নিহতদের শব, রেলপথে উপড়ানো লাইন ও লাইনচ্যুত ট্রেনের বগি পড়িয়া আছে। এই অবস্থায় জাতীয় সংসদের নির্বাচনের যে-প্রস্তুতি চলার কথা, তাহা ধাক্কা খাইতে বাধ্য। একে তো আদালত নির্বাচনে জামাতে ইসলামির অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করিয়াছে। উপরন্তু বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচন বয়কটের সিদ্ধান্ত জানাইয়া দিয়াছে। তদুপরি জাতীয় পার্টির নেতা প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট অশীতিপর হুসেন মহম্মদ এরশাদ শেষ মুহূর্তে নির্বাচন হইতে সরিয়া দাঁড়ানোর পরে ভোররাত্রে তাঁহাকে
বাড়ি হইতে বন্দি করিয়া পুলিশ অজ্ঞাত স্থানে লইয়া গিয়াছে। এই নির্বাচন আর যাহাই হউক, কোনও সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং
অবাধ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া যে হইতে পারে না, তাহা এখন একপ্রকার নিশ্চিত।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন-সহ বাংলাদেশের পশ্চিমী মিত্র ও সাহায্যকারীরা উভয় পক্ষকেই সংযম, ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা অবলম্বনের আর্জি জানাইয়াছে। ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রকের আধিকারিক প্রধানমন্ত্রী হাসিনা ও বিরোধী নেত্রী খালেদার সহিত আলোচনার সময়েও একই অনুরোধ করিয়া থাকিবেন, যেমন করিয়াছেন রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিবের প্রতিনিধি। কিন্তু তাহাতে বরফ গলে নাই। উভয় পক্ষই নিজ-নিজ অবস্থানে অনড়, কোনও মধ্যপন্থা বা আপসের সম্ভাবনাও অন্তর্হিত। অথচ এই দরিদ্র দেশটিতে শান্তি ও স্থিতি ফিরিয়া আসাটা দেশবাসীর উন্নয়নের স্বার্থেই জরুরি। তাহা যে সম্ভব হইতেছে না, তাহার একটি বড় কারণ দুই নেত্রীর অহমিকার দ্বন্দ্ব। এক জন যখন জনাদেশে প্রধানমন্ত্রী হন, অন্য জন তখন তাহা অগ্রাহ্য করিয়া সংসদ বয়কটের পথে হাঁটেন। এই পরিষদীয় ঐতিহ্যই বাংলাদেশের বিষাক্ত রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার সার কথা। কেহ কাহাকেও এক ইঞ্চি জমি ছাড়িতে নারাজ, পরবর্তী নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করিতেও নারাজ। জনসাধারণের কল্যাণ ও মঙ্গলের বৃহত্তর প্রশ্ন, সামাজিক উন্নয়ন ও আর্থিক বিকাশের জরুরি কর্তব্য সম্পাদন ব্যাহত হইতেছে। কিন্তু গত কয়েক মাসের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উদ্বেগজনক হইয়া উঠিয়াছে জঙ্গি মৌলবাদী শক্তির দাপট এবং অগ্রগতি। বি এন পি’কে এই বিপদ লইয়া বিশেষ ভাবে চিন্তা করিতে হইবে, কারণ এই ধরনের শক্তির সহযোগিতায় ক্ষমতা অর্জনের ‘সাফল্য’ শেষ অবধি একটি রাজনৈতিক দলের পক্ষে আত্মঘাতী বলিয়া প্রমাণিত হইতে পারে। পাকিস্তান-সহ বিভিন্ন দেশের সাম্প্রতিক ইতিহাস তাহার বহু নজির বহন করিতেছে। |