এক দিনের জন্য ব্যাটম্যান হতে চেয়েছিল সান ফ্রান্সিসকোর বাসিন্দা, বছর পাঁচেকের মাইলস স্কট। দেড় বছর বয়স থেকেই যে আক্রান্ত লিউকেমিয়ায়। মৃত্যুর ভ্রূকুটিকে অগ্রাহ্য করে মাইলসের মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলতে এগিয়ে এসেছিল এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। এর পরেই সুপারহিরোর চেনা পোশাকে একটা গোটা দিন শহর মাতিয়ে রেখেছিল ওই খুদে ব্যাটম্যান। তাকে উৎসাহ দিতে পথে নেমেছিলেন হাজার হাজার মার্কিন নাগরিক। শুভেচ্ছাবার্তা এসেছিল প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার কাছ থেকেও।
উদাহরণ আছে হাতের কাছেও। হুগলির হরিপাল থেকে আসা ক্যানসার আক্রান্ত বছর পাঁচেকের সুরজ বিনবংশী এক দিনের জন্য দারোগা হয়ে বসেছিল নিউ টাউন থানায়। উর্দি পরা থানার অফিসার থেকে পেয়াদা সকলেই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মতো অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন তাকে।
এ বার ইচ্ছেপূরণের এমনই এক তৃপ্তি পেল বাংলাদেশের বাসিন্দা, সাড়ে চার বছরের ফারহান রানা অপূর্ব। সে-ও ক্যানসারে আক্রান্ত। চিকিৎসা করাতে এসেছিল এ শহরের ঠাকুরপুকুরের একটি বেসরকারি ক্যানসার হাসপাতালে। তার স্বপ্নের নায়ক সলমন খানের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিল সে। ‘দাবাং’ সিনেমার সব গান মুখস্থ তার। চেয়েছিল, সলমনের সঙ্গে দেখা করে ওই গানগুলো শোনাতে। আর তার পরেই তার সেই আবদার রাখতে উঠেপড়ে লাগেন তার মা-বাবা এবং একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। শেষে ইচ্ছেপূরণ হয় ফারহানের। সম্প্রতি ছোট্ট ফারহানকে কোলে নিয়ে মারপিটের দৃশ্যের ‘শ্যুটিং’ করেছেন সলমন। ছবির সেটে তাকে কোলে নিয়ে ঘুরেছেন। দিয়েছেন চকোলেটের বাক্সও। স্বপ্নপূরণের পরে এখন ফারহান কিছুটা ভালই আছে বলে জানাচ্ছেন চিকিৎসকেরা। এমনকী, তাঁরা জানিয়েছেন, এর পরে কেমো নেওয়ার সময়ে ব্যথা কমানোর মরফিনও প্রয়োজন হয়নি তার। বাংলাদেশে ওই শিশুটির বাবা-মায়ের কাছ থেকে জানা গিয়েছে, এখন ভালই রয়েছে সে। |
দু’বছর আগে বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জ থেকে প্রথম ফারহানকে ঠাকুরপুকুরের ওই হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। হাসপাতালের হেমাটোঅঙ্কোলজির চিকিৎসকেরা জানিয়েছিলেন, ফারহানের কিডনির উপরে যে টিউমারটি ছিল, তা পরীক্ষা করে দেখা যায়, সেটি ম্যালিগন্যান্ট। ওই সময়ে সে ব্যথায় এতই কাতর ছিল যে, ব্যথা কমাতে মরফিন দিতে হচ্ছিল তার শরীরে। ঠাকুরপুকুর ক্যানসার হাসপাতালের হেমাটোঅঙ্কোলজির চিকিৎসক সোমা দে বলেন, “শিশুটি বাংলাদেশ থেকে যখন প্রথমে এল, তখনই চিকিৎসায় অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। তা-ও আমরা চেষ্টা করেছি। ব্যথার চোটে ভাল করে কথাও বলতে পারছিল না। তখন একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার মাধ্যমে জানতে পারি, শিশুটি সলমনের খানের ভক্ত। সলমনের সঙ্গে দেখা করতে চায় সে।”
এই ইচ্ছা যে কতটা তীব্র, তা বোঝা যায় যখন বাবা মসুদ রানা মিন্টো ও মা শিখার সঙ্গে চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে চিকিৎসার জন্য কলকাতায় আসে ফারহান। চিকিৎসকেরা জানান, প্রথম কেমোটা খুব কষ্ট করে নিয়েছিল সে। সোমাদেবী বলেন, “চোখের সামনে শিশুটির অবস্থা দ্রুত খারাপ হচ্ছিল। ক্রমেই আমাদের হাতের বাইরে চলে যাচ্ছিল। ফারহানের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি, ও যে ভাবেই হোক, এক বার সলমনের সঙ্গে দেখা করতে চায়। ওই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনই তখন সলমনের খানের সচিবের সঙ্গে যোগাযোগ করে। সলমন জানান, শিশুটিকে মুম্বই নিয়ে গেলে তার সঙ্গে দেখা করতে কোনও অসুবিধা নেই তাঁর।” ওই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের পক্ষে গোবিন্দ রায় বলেন, “সলমনের কাছ থেকে সম্মতি পেতেই মুম্বই যাওয়ার প্রস্তুতি নিই।”
ঠিক হয়, ১৯ সেপ্টেম্বর সলমনের সঙ্গে ফারহানের দেখা হবে। ফারহানের মা-বাবা, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের এক কর্মী ছাড়াও সঙ্গে যান ওই হাসপাতালের হেমাটোঅঙ্কলজির চিকিৎসক প্রদীপ্ত দাস। প্রদীপ্তবাবু বলেন, “মুম্বইয়ে শুধু সলমনের দেখাই হল না, অসুস্থ ফারহানের জীবনও বদলে গেল।”
কী রকম সেই পরিবর্তন?
প্রদীপ্তবাবু জানালেন, মুম্বই যাওয়ার কথা শুনেই উজ্জীবিত হয়ে উঠেছিল ফারহান। বিমানবন্দরে নেমে একটি অ্যাম্বুল্যান্সে করেই সলমনের শ্যুটিং স্পটে যান তাঁরা। এত দিন ব্যথা কমানোর জন্য যাকে মাঝেমধ্যেই মরফিন দিতে হচ্ছিল, সেই ফারহানকে তখন চেনাই ভার। কে বলবে, তার কোনও কঠিন রোগ আছে। মুম্বইয়ে রানিবাগ এলাকার একটি বন্ধ কারখানায় শ্যুটিং করছিলেন সলমন। তাঁরা সেখানে পৌঁছন দুপুর আড়াইটে নাগাদ। প্রদীপ্তবাবু বলেন, “ফারহানের সঙ্গে দেখা করতে সলমন নিজেই অ্যাম্বুল্যান্সে আসেন। আমার কাছে তার অসুখের খুঁটিনাটি জানতে চান। তখন ফারহানের চোখ-মুখ দেখার মতো। এত দিন যে স্বপ্নের নায়ককে দেখার জন্য পাগল ছিল, তাকে চোখের সামনে দেখে কিন্তু ও বেশ লজ্জাই পাচ্ছিল।”
তবে সলমনের ব্যবহারই নিমেষের মধ্যে ফারহানের লাজুক ভাব কাটিয়ে দেয়। ফারহানের কাছে তিনি জানতে চান, সে কী দেখতে চায়। ঝটপট জবাব ফারহানের, মারামারির শ্যুটিং। সঙ্গে সঙ্গে সব ব্যবস্থা করে ফেললেন শ্যুটিং ইউনিটের সদস্যেরা। ফারহানের সামনেই মারামারির দৃশ্য করে দেখালেন সলমন। প্রদীপ্তবাবু বলেন, “দূর থেকে সলমনকে মারামারি করতে দেখে ফারহান আর চুপ থাকতে পারেনি। সোজা ছুটে গিয়ে সে উঠে পড়ে সলমনের কোলে। এর পরে আধ ঘণ্টা ফারহানকে কোলে নিয়েই ঘুরেছেন সলমন।”
ওই আধ ঘণ্টাই কিন্তু ছোট্ট ফারহানের জীবনে এনে দিয়েছে এক অফুরান প্রাণশক্তি। প্রদীপ্তবাবু জানাচ্ছেন, সলমনের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর থেকে সে এতটাই উজ্জীবিত ছিল যে, বিমানে ফেরার সময়েও সোমাদেবীদের সঙ্গে গল্প করছিল। তখন ওকে দেখে কে বলবে যে ওর মধ্যে এতটা প্রাণশক্তি রয়েছে? সোমাদেবী বলেন, “ওকে প্রথম কেমো দেওয়ার সময়ে ও কোনও সাড়া দিচ্ছিল না। অথচ দ্বিতীয় কেমো দিতে কোনও অসুবিধা হয়নি। যন্ত্রণা সহ্য করার জন্য মরফিনও লাগেনি ওর।” চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, দিন কয়েক আগে যখন বাবা-মায়ের সঙ্গে বাংলাদেশ থেকে আসে ফারহান, তখন তাকে দেখে আগের চেয়ে অনেকটা সুস্থ মনে হয়েছে। সোমাদেবী বলেন, “ওর মধ্যে একটা পজিটিভ এনার্জি কাজ করছিল। ওই পজিটিভ এনার্জি নিয়েই ফারহান বাংলাদেশে ফিরে গিয়েছে।”
কিন্তু এমনটা কী সত্যিই সম্ভব?
ক্যানসার-চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায় জানান, পজিটিভ এনার্জি যাঁদের বেশি থাকে, তাঁরা ব্যথা-বেদনা অনেক কম অনুভব করেন। ফারহানের ক্ষেত্রে তেমনই হয়েছে। সুবীরবাবু বলেন, “সলমন খানের সঙ্গে দেখা করে শিশুটির মধ্যে এমন একটা মানসিক জোর তৈরি হয়েছে যে, তা তাকে ক্যানসারের মতো কঠিন অসুখের বিরুদ্ধে লড়তে সাহায্য করছে। বিদেশে এ রকম বিকল্প চিকিৎসা নিয়ে প্রচুর কাজ হচ্ছে। দেখা গিয়েছে, অসুখ হলে এক জন অবসাদগ্রস্ত মানুষ অনেক বেশি ব্যথা-বেদনা ভোগ করেন। স্বপ্নের নায়ককে দেখার পরে এই শিশুটির অবসাদ এতটাই কমে গিয়েছে যে, তার ব্যথা কমানোর মরফিনও লাগেনি।” |