সকাল দশটা বেজে পনেরো মিনিট পেরিয়ে গিয়েছে। পুরুলিয়ার আঞ্চলিক পরিবহন দফতরের কার্যালয়ের সব দরজাই তখনও বন্ধ। শেষমেশ একগুচ্ছ চাবি হাতে ঢুকে চতুর্থ শ্রেণির এক কর্মী যখন দরজার তালা খুললেন, ঘড়ির কাঁটা তখন সাড়ে দশটা ছুঁয়েছে। শুরু হল ঝাঁট দেওয়ার পালা। দফতরের ১৬ জন কর্মীর মধ্যে তখন একমাত্র উপস্থিত এমভিআই (টেকনিক্যাল) মানবেন্দ্র ভট্টাচার্য। খোদ রিজিওনাল ট্রান্সপোর্ট অফিসার (আরটিও) সব্যসাচী ঘোষ দফতরে ঢুকলেন দশটা চল্লিশ মিনিট নাগাদ। অফিসের বাকি কর্মীদের একাংশ গুটিগুটি পায়ে যখন অফিসে ঢুকছেন ঘড়ির কাঁটা এগারোটা পেরিয়ে গিয়ছে। বাকিরা এলেন তারও কিছু পরে।
এই ছবি বুধবারের। সকালে জেলা শাসকের কার্যালয়ের ঠিক পাশেই, আঞ্চলিক পরিবহন দফতরের কার্যালয়ে গিয়ে এই ছবিই চোখে পড়ল। সকাল দশটা বাজার কিছু পরেই এক আত্মীয়ের মোটরবাইকের নথি জমা দিতে এই কার্যালয়ে এসেছিলেন পুরুলিয়া ১ ব্লকের লাগদার বাসিন্দা পেশায় অটো চালক রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়। সংশ্লিষ্ট কর্মী না পৌঁছনোয় প্রায় এক ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হল তাঁকে। বললেন, “সামান্য কাজ, ভেবেছিলাম দ্রুত সেরে ফিরে যাবো। কিন্তু কর্মীই নেই। কখন আসবেন, জানার উপায় নেই।” |
একই অভিজ্ঞতা পুরুলিয়া ২ ব্লকের হুটমুড়ার বাসিন্দা সেখ সাজিদ, পুঞ্চা ব্লকের বাসিন্দা বাবলু দুয়ারীদের। কয়েক দিন আগে মোটরবাইকের নাম্বার প্লেট বসিয়ে এদিন সকালেই বাইকের ‘ওনার বুক’ বা রেজেস্ট্রিশন সংক্রান্ত নথি নিতে পুরুলিয়াতে এসেছিলেন দুই যুবক। দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করার পরে তাঁদের শুনতে হয়েছে, “দেরি হবে, ঘুরে আসুন।” সাড়ে বারোটার পরে নথি পেয়েছেন তাঁরা। যদিও নিয়ম অনুযায়ী নাম্বার প্লেট বসানোর একদিনের মধ্যেই সেই নথি হাতে পাওয়ার কথা।
আঞ্চলিক পরিবহন দফতরের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ পেয়ে পুরুলিয়ার পূর্বতন জেলাশাসক মহম্মদ গুলাম আলি আনসারি এই দফতরের আরটিও-সহ পাঁচ কর্মীকে অন্যত্র বদলি করেছিলেন। জেলাশাসকের অবশ্য বলেছিলেন, এটা রুটিন বদলি। কিন্তু প্রশাসনের শীর্ষস্তর থেকে নেওয়া ব্যবস্থাতেও যে এই দফতরের কর্মসংস্কৃতির হাল ফেরেনি, তা স্পষ্ট। এ দিন ড্রাইভিং লাইসেন্স নিতে এসেছিলেন পুরুলিয়ার একটি বেসরকারি ব্যাঙ্কে কর্মরত জীবক গিরি। আদতে কলকাতার বাসিন্দা জীবকবাবু এদিন সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ এসেছিলেন তাঁর ড্রাইভিং লাইসেন্স হয়েছে কিনা খোঁজ নিতে। বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়ানোর পরে তাঁকে পর দিন আসতে বলা হল। নিয়ম হল, আবেদন করার ছয় মাসের মধ্যে লাইসেন্স মিলবে। জীবকবাবু আবেদন করেছেন ১৪ মাস আগে। “মাঝেমাঝেই খোঁজ নিতে আসি, এই একই কথা শুনে যাই। কবে লাইসেন্স পাব, কে জানে।” পরিষেবার হাল স্পষ্ট হল যখন দেখা গেল, ড্রাইভিং লাইসেন্সের আবেদন করার নির্দিষ্ট ফর্মই নেই দফতরে। সংশ্লিষ্ট কর্মী জানান, ফর্ম পাওয়া যাবে ফটোকপির দোকানে বা টাইপিস্টের কাছে। |
সকাল ১০টা ৩৭ |
সকাল ১০টা ৪১ |
অফিসে পড়ল ঝাড়ু। |
এলেন পরিবহণ আধিকারিক। |
|
জোর করে বকশিস আদায়ের অভিযোগও শোনা গেল। হুটমুড়ার বাসিন্দা শেখ সাজিদ বলেন, “সোমবার বাইকে নাম্বার প্লেট লাগাতে এসে ২০ টাকা দিতে হয়েছে। কী জন্য টাকা লাগবে জানতে চেয়েছিলাম। শুনতে হয়েছে এটাই নিয়ম, সবাইকেই দিতে হয়।” এদিন অবশ্য কেন কর্মীরা দেরি করে আসেন, কেনই বা তিনি নিজে দেরিতে আসছেন এই প্রশ্নের উত্তর দিতে চাননি আরটিও সব্যসাচী ঘোষ। তিনি বলেন “আমাদের ফিল্ড ওয়ার্ক থাকে। সকাল সাড়ে ছটা থেকে কাজ শুরু করি আমরা।” অন্যান্য প্রশ্নের উত্তরে আরটিও-র মন্তব্য “জেলাশাসকের কাছে জেনে নিন। দফতরের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সংবাদ মাধ্যমকে জানাবোই বা কেন?”
কাউকে কোনও প্রশ্ন না করেও অবশ্য কিছু জিনিস স্পষ্ট হয়ে যায়। যেমন, প্রতিদিন শতাধিক নাগরিক নানা কাজে আরটিও দফতরে এলেও, অতিথিদের বসার কোনও জায়গাই নেই। খানিক দূরে একটি গাছের বাঁধানো বেদীই ভরসা। নেই সামান্য পানীয় জলের ব্যবস্থাও। গ্রাহকের প্রতি তাচ্ছিল্য, অবহেলা নিয়ে খুঁড়িয়ে চলছে আঞ্চলিক পরিবহন আধিকারিক। |