ফের খয়রাশোলের জলে মিলল মাত্রাতিরিক্ত ফ্লোরাইড
কারও কোমর বয়সের তুলনায় অনেকটাই ঝুঁকে পড়ছে, কারও শরীরের নানা হাড়ে, কারও বা দাঁতে দেখা দিয়েছে ক্ষয়। বছর খানেক ধরেই গ্রামের অনেকের শরীরেই এমন পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছিল। আর তা থেকেই আশঙ্কাটা তৈরি হয়েছিল। কার্যত সেই আশঙ্কাই সত্যি প্রমাণিত হল। সম্প্রতি ব্লক প্রশাসনের উদ্যোগে আইআরডিপি-র (ইন্টিগ্রেটেড রুরাল ডেভলপমেন্ট প্রোগ্রাম) আওতায় করা জল পরীক্ষায় খয়রাশোলের লাউবেড়িয়া গ্রামের ১২টি গভীর (২৫০-৩০০ ফুট) নলকূপেই মাত্রাতিরিক্ত ফ্লোরাইড মিলেছে। কিন্তু অভিযোগ, ১২টি নলকূপের একটিকেও এখনও বন্ধ করা হয়নি। এমনকী, পানীয় জলের বিকল্প কোনও ব্যবস্থা না থাকায় ফ্লোরাইড মিশ্রিত জলই খেতে বাধ্য হচ্ছেন গ্রামের দু’ হাজারেরও বেশি মানুষ। খরাশোলের বিডিও মহম্মদ ইসরারের অবশ্য দাবি, “গ্রামের মানুষের সমস্যা মেটাতে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।”
বিষ জল? খয়রাশোলের একটি গ্রামে।—ফাইল চিত্র।
প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্রে খবর, রাজ্যে প্রথম ১৯৯৬ সালে বীরভূমের নলহাটি ১ ব্লকের ভূগর্ভস্থ জলে মাত্রাতিরিক্ত ফ্লোরাইড মিলেছিল। পরর্বতী সময়ে রামপুরহাট ১, সাঁইথিয়া, ময়ূরেশ্বর ১, সিউড়ি ২, রাজনগর, খয়রাশোল ব্লকেও ভূগর্ভস্থ জলে মাত্রাতিরিক্ত ফ্লোরাইড ধরা পড়ে। খয়রাশোল ব্লকের নলকূপের জলে মাত্রার দিক থেকে তেমন ভাবে ফ্লোরাইড না মিললেও বছর পাঁচেক আগে প্রথম জামরান্দ ও ফুল্লচক গ্রামে বহু গুন বেশি ফ্লোরাইড মিলেছিল। তার পর থেকে সেখানকার নলকূপগুলি বন্ধ করে দেওয়া হয়। ইউনিসেফ এবং জনস্বাস্থ্য ও কারিগরী দফতরের যৌথ উদ্যোগে বাসিন্দাদের ‘ফ্লোরাইড ফিল্টার’ বিতরণ করা হয়। যদিও সচেতনতার অভাবে একটা বড় অংশের মানুষই তা ব্যবহার করেননি। বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, এই অবস্থায় নদী বা বড় জলাশয় থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে পানীয় জল সরবরাহ করা গেলে তা সবথেকে ভাল। কারণ ভূগর্ভস্থ জল যত গভীর থেকে তোলা হবে, ততই তাতে ফ্লোরাইডের মাত্রা বাড়বে। কিন্তু এত দিনেও ওই দুই গ্রামে পরিস্রুত পানীয় জল পৌঁছে দিতে কোনও বিকল্প ব্যবস্থা গড়া হয়নি। যদিও খয়রাশোল ব্লকের ২৬টি গ্রামের জন্য অজয় নদের থেকে পাইপ লাইনের মাধ্যমে পরিস্রুত পানীয় জল পৌঁছে দেওয়ার একটি প্রকল্পের কাজ এখন চলছে। সম্প্রতি জেলা প্রশাসন জামরান্দ ও ফুল্লচক গ্রামেও অজয়ের পরিস্রুত পানীয় জল পৌঁছে দিতে একটি পৃথক প্রকল্পের কাজ শুরু করেছে। কিন্তু ২০১৫-র আগে যে তা শেষ হবে না তা ধরেই নিয়েছেন পিএইচই দফতর। ওই দুই গ্রামের ১০-১২ কিলোমিটারের মধ্যেই পড়ে লাউবেড়িয়া। তার ৬-৭ কিমির মধ্যে হজরতপুরেও আবার আগেই ফ্লোরাইড ধরা পড়েছিল। খয়রাশোল পঞ্চায়েত সমিতির প্রাক্তন সভাপতি, সিপিএমের সমীর রায়ের দাবি, “খয়রাশোলের আনন্দনগর, ভাড্ডি, কেন্দ্রগড়িয়াতেও ফ্লোরাইড মিলেছিল। তখন লাউবেড়িয়ার কয়েকটি নলকূপেও তা পাওয়া গিয়েছিল।”
এমনিতে রাজ্য ফ্লোরাইড কন্ট্রোল বোর্ডের নির্দেশিকা অনুযায়ী প্রতি লিটার জলে ফ্লোরাইডের পরিমাণ ১.৫ মিলিগ্রামের বেশি হলেই তা পানের পক্ষে বিপজ্জনক। খয়রাশোল পঞ্চায়েতের সূত্রে খবর, লাউবেড়িয়ায় ওই পরিমাণ কমবেশি ২-৪ মিলিগ্রাম। বাসিন্দাদের দাবি, আগে গ্রামের কয়েকটি নলকূপে ফ্লোরাইড মিললেও তার পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত ছিল না। কিন্তু সম্প্রতি দেখা যায় গ্রামে হাড় ও দাঁতের ক্ষয়জনিত (ফ্লুরোসিস) সমস্যায় আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছিল। কোমর বেঁকে গিয়ে চলাফরা করতে অসুবিধায় পড়েছেন বেশ কয়েক জন গ্রামবাসী। তার পরেই বাসিন্দাদের সন্দেহ হয়, গ্রামের অন্যান্য নলকূপেও ফ্লোরাইড থাকতে পারে। তার মাত্রাও বেড়েছে। সাম্প্রতিক পরীক্ষার ফল তারই প্রমাণ দিল। ইতিমধ্যেই আক্রান্ত হয়েছেন বিদ্যুত্‌ বাঁশরী, শ্রীরাম ঘোষ, সত্যমতি বাঁশরী ও পবিত্রা ঘোষের মতো বাসিন্দারা। তাঁরা বলছেন, “নলকূপের জল খেয়ে যে এ রকম অসুখে পড়ব, তা আগে জানা ছিল না।” তাঁদের দাবি, বছর কয়েক আগেও কয়েকটি নলকূপের জলে মাত্রাতিরিক্ত ফ্লোরাইড ধরা পড়েছিল। তখন তা বন্ধ করে দেওয়া হলেও নতুন করে গ্রামের নলকূপে ফ্লোরাইড ধরা পড়ায় সমস্যা আরও বেড়েছে। ফ্লোরাইডে গ্রামবাসীদের আক্রান্ত হওয়ার কথা স্বীকার করে নিয়েছেন ওই গ্রামেরই বাসিন্দা তথা খয়রাশোল পঞ্চায়েতের প্রধান ভূপেন্দ্রনাথ ঘোষ এবং খয়রাশোল পঞ্চায়েত সমিতির সহ-সভাপতি আব্রার হোসেন। দু’জনেই বললেন, “লাউবেড়িয়ায় অনেকেরই ফ্লোরাইডে নানা অসুখ দেখা দিয়েছে। গত কয়েক মাস ধরেই আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ার পরে বিষয়টি ব্লক ও জেলা প্রশাসনের নজরে আনা হয়।” বিষয়টি নজরে আছে জনস্বাস্থ্য ও কারিগরী দফতরেরও।
এই পরিস্থিতিতে এক সঙ্গে এতগুলি নলকূপে ফ্লোরাইড মেলায় সমস্যায় পড়েছেন বাসিন্দারা। সত্যমতিদেবীরা বলছেন, “রাতারাতি কোথায় থেকে পরিস্রুত পানীয় জল পাব? ওই বিষ জলই আমাদের খেতে হচ্ছে।” যদিও প্রশাসন সূত্রে খবর, অজয় থেকে পরিস্রুত পানীয় জল গ্রামে গ্রামে পৌঁছে দেওয়ার তালিকায় লাউবেড়িয়াও রয়েছে। বাসিন্দারা অবশ্য জানাচ্ছেন, সেই কাজ এখনও শেষ হয়নি। এমনকী, প্রকল্পে তাঁদের গ্রামে মাত্র ১১টি সংযোগ দেওয়া হয়েছে। যা পুরো গ্রামের চাহিদা মেটাতে পারবে না। যদিও গ্রামবাসীদের আশ্বস্ত করে পিএইচই-র এগজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার অর্ধেন্দু দত্ত বলছেন, “আর কয়েক দিনের মধ্যেই লাউবেড়িয়ার মানুষ পরিস্রুত পানীয় জল পেতে শুরু করবেন। দরকার পড়লে সেখানে জলের সংযোগ আরও বাড়ানো যেতে পারে। আমরা খয়ারশোলের সব ক’টি ফ্লোরাইড প্রভাবিত গ্রামেই পাইপ লাইনের মাধ্যমে পরিস্রত পানীয় জল সরবরাহ করার ব্যবস্থা করেছি। দ্রুত সেই কাজ শেষ হবে।” অন্য দিকে, জেলা পরিষদের স্বাস্থ্য কর্মাধ্যক্ষ জাফারুল ইসলামও বলেন, “বীরভূমের ফ্লোরাইড প্রভাবিত এলাকাগুলির ভূগর্ভস্থ জলে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করা দেখা হচ্ছে, সেখানে তার মাত্রা ঠিক কতখানি। একই সঙ্গে ওই সব এলাকার জন্য কাছাকাছি কোনও জলাশয় থেকে জল তুলে পরিস্রুত করে পাইপ লাইনের মাধ্যমে দেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে।”
এ দিকে, এত দিন জেলায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পানীয় জলে ফ্লোরাইডের মাত্রা পরীক্ষা করার জন্য বিভিন্ন এনজিও-র মাধ্যমে জল পরীক্ষাগারে পাঠানো হত। সম্প্রতি রাজ্য সরকার রামপুরহাটের মাঝখণ্ড গ্রাম লাগোয়া জমিতে জনস্বাস্থ্য কারিগরী দফতর পরিদর্শন বাংলো গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়। সেখানে জল পরীক্ষার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা থাকবে। যদিও কিছু দিন আগেই নির্মীয়মান বাংলোর কাজের অগ্রগতি দেখতে এসে সন্তুষ্ট হননি দফতরের মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়। তিনি বিভাগীয় বাস্তুকারদের কাজটি দ্রুত শেষ করার জন্য নির্দেশও দেন। সুব্রতবাবু দাবি করেন, “এই জেলার ভূগর্ভস্থ জলে প্রচুর ফ্লোরাইড আছে। আমরা এক দেড় বছরের মধ্যে আক্রান্ত সব জায়গায় ফ্লোরাইড মুক্ত পরিস্রুত জল পৌঁছে দিতে চাই। তার জন্য ইতিমধ্যেই সব রকমের পদক্ষেপ করা হয়েছে।”

পুরনো খবর:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.