|
|
|
|
সাবেকিয়ানা মেনেও বিয়ে দিচ্ছেন নন্দিনীরা |
উৎপল সরকার • কলকাতা |
পাত্র সৌমিত্র আচার্য এখন পুণের বাসিন্দা, বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত। পাত্রী তানিয়া রায়চৌধুরী চাকরি করেন মুম্বইয়ে। মা-বাবা ও আত্মীয়স্বজনের উপস্থিতিতে শুক্রবার দিঘায় বিলাসবহুল এক রিসর্টে বিয়ে হয়েছে দু’জনের।
এই অবধি কোনও জটিলতা নেই। কিন্তু বেহালার বাসিন্দা সুমন্ত রায়চৌধুরীর কন্যা তানিয়ার বিয়ে দিয়েছেন সংস্কৃতের অধ্যাপক নন্দিনী ভৌমিক ও রুমা রায়। মধ্যবিত্ত বাঙালি বিয়েতে সাধারণত পুরুষের পৌরোহিত্য দেখেই অভ্যস্ত। মাঝে মাঝে কদাচিৎ আলোর রেখা দেখা যায়। কয়েক দশক আগে যেমন অপর্ণা সেনের কন্যা কমলিনীর বিয়ে দিয়েছিলেন গৌরী ধর্মপাল। এ নিয়ে বিতর্ক দানা বেঁধেছিল তখনই। তানিয়া-সৌমিত্রর বিয়ে নতুন করে উস্কে দিল সেই পুরনো বিতর্ক। যদিও পাল্লা ভারী কিন্তু মেয়েদের দিকেই। |
|
গত শুক্রবার সৌমিত্র-তানিয়ার বিয়ে দিয়েছেন রুমা-নন্দিনী। ছবি: উৎপল সরকার। |
কেন ‘যদিদং হৃদয়ং তব’ মন্ত্রোচ্চারণ করানোয় পুরুষেরই একাধিপত্য? সুকুমারী ভট্টাচার্যের মতে, এ ক্ষেত্রে শাস্ত্রীয় নিয়মে নারী-পুরুষ ভেদ নেই। বেদে গার্হস্থ্য নিয়ে যে সব রীতিনীতি, সেই গৃহ্যসূত্র এক বারও বলেনি, বিবাহদান শুধুই পুরুষের অধিকার। প্রায় একই সুর সাহিত্যিক নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়িরও। “বেদে তো লোপামুদ্রা, ঘোষা অনেক মহিলা-ঋষি ছিলেন। তাঁরা মন্ত্রদর্শনও করেছেন।” অর্থাৎ পৌরোহিত্যে পুরুষের একাধিপত্য মোটেই শাস্ত্রের কারণে নয়, সামাজিক রীতিনীতিই এর জন্য দায়ী মনে করেন তিনি।
নৃসিংহপ্রসাদবাবুর সঙ্গে কিন্তু মোটেই একমত নন প্রবীণ শাস্ত্রজ্ঞ হিমাংশু স্মৃতিতীর্থ। তাঁর সাফ কথা, মেয়েরা পৌরোহিত্য করতে পারেন এমন কোনও বিধান শাস্ত্রে নেই। “তাঁরা তো প্রণব মন্ত্রই উচ্চারণ করতে পারেন না, উপবীতও নেই, তা হলে যজ্ঞ করবেন কী ভাবে,” প্রশ্ন তাঁর।
পৌরোহিত্য পুরুষের একচেটিয়া, তা অবশ্য মানতে নারাজ শ্রী সারদা মঠের প্রবীণ সন্ন্যাসিনী প্রব্রাজিকা অশেষপ্রাণা। বললেন, স্বামীজি বিশ্বাস করতেন মেয়েদের বেদ পাঠের অধিকার যবে থেকে কেড়ে নেওয়া হয়, পিছিয়ে পড়া শুরু তখন থেকেই। মেয়েদের দূরে ঠেলে রাখা
ঘোর অপছন্দ ছিল স্বামী বিবেকানন্দের। তাই মঠে কালীপুজো থেকে জগদ্ধাত্রী বা সরস্বতী পুজো সবই করেন মহিলারা। এমনকী, সারদা মা নিজে এক সময় পুজো করেছেন। “মেয়েরা পুরোহিত হতে পারবেন না তা-ই বা মানি কী করে,” জানাচ্ছেন অশেষপ্রাণা।
শাস্ত্র নয়, সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় আবার এ ব্যাপারে ভরসা রাখছেন যুগের হাওয়াতেই। তাঁর কথায়, “সময় পাল্টাচ্ছে, মেয়েরা এখন নিজেদের অধিকার বুঝে নিচ্ছে সব জায়গাতেই।” নারী পুরোহিতে তাই বিস্ময়ের কিছু দেখছেন না শীর্ষেন্দুবাবু। যুগ বদলকে অস্বীকার করছেন না কালীঘাটের প্রধান পুরোহিত শান্তিপদ কৃত্যতীর্থও। পড়াশোনা, চাকরিবাকরি বহু ক্ষেত্রেই ছেলেদের পিছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে মেয়েরা, মেনে নিচ্ছেন এই প্রবীণ পুরোহিত। “তবু লাটাইটা যেন ছেলেদের হাতেই” স্বগতোক্তির ঢঙেই বললেন শান্তিপদবাবু। মেয়েরা ঋকবেদ পড়তে পারবেন না, প্রণব মন্ত্র উচ্চারণ করতে পারবেন না, এই বিধিনিষেধ মেনে নিতে কষ্ট হয় তাঁর। “কিন্তু আমার হাত-পা বাঁধা। যে ট্র্যাডিশন চলে আসছে, চাইলেই তো আমি তা ভাঙতে পারি না,” জানিয়েছেন শান্তিপদবাবু।
নন্দিনী-রুমারা ধর্মকে হাতিয়ার করে সেই ট্র্যাডিশনকেই চ্যালেঞ্জ ছুড়ছেন। দিঘার বিয়ের আসরে বৈদিক মন্ত্রোচ্চারণ করেছেন এই দুই বঙ্গ নারীই। নন্দিনী জানালেন, “হিন্দু ধর্মে আমরা বিশ্বাস করি, মন্ত্র যদি নির্ভুল ভাবে উচ্চারণ করা যায় তবেই তা ভগবানের কাছে পৌঁছয়। আজকাল তো দেখি এমন অনেকে বিয়ে দিচ্ছেন যাঁরা ভাল করে মন্ত্রই উচ্চারণ করতে পারেন না। কেবল পিতৃদত্ত অধিকারে পৌরোহিত্য করে আসছেন। আমরা বৈদিক নিয়মে, শুদ্ধ মন্ত্রোচ্চারণে বিয়ে দিই।” ভগবানকে স্মরণ করেই প্রথা ভাঙছেন তাঁরা।
তবে কি নির্ভুল মন্ত্রোচ্চারণই একমাত্র মাপকাঠি? “উচ্চারণ অনেকে নানা রকম করেন। কেউ ‘বিষ্ণায়’ বলে ভুল মন্ত্র উচ্চারণ করেন। কেউ আবার ‘বিষ্ণবে’ বলে সঠিক উচ্চারণ করেন। শাস্ত্রে বলা হয়েছে, বোধ থেকে উচ্চারণ করলে দুটি মন্ত্রই ফলদায়ক। উচ্চারণ নয়, মন্ত্রগুলি বোধ করাই আসল,” বলছেন নৃসিংহবাবু। নারী, পুরুষ দু’জনেই সেই বোধে উন্নীত হতে পারেন, লিঙ্গজনিত বাধা নেই। সুকুমারী দেবী গোটা বিষয়টাকে অন্য চোখে দেখছেন, “সামাজিক রীতিতে পুরুষরা প্রাধান্য পায় ঠিকই, কিন্তু বিয়েতে বহু আচার পালন করান মেয়েরাই।”
তানিয়া-সৌমিত্রর বিয়ে অগ্নিসাক্ষী করে হলেও কন্যাদানের আচার কিন্তু ভেঙেছেন নন্দিনীরা। “কন্যা কি কারও সম্পত্তি যে তাকে দান করা যায়? তা হলে পুত্র দানই বা হবে না কেন?” প্রশ্ন তাঁদের। প্রশ্নটি আধুনিক মননের উপযোগী, সন্দেহ নেই। “কিন্তু তা হলে অগ্নিসাক্ষী করে বিয়ের অনুষ্ঠানই বা কেন? রেজিস্ট্রি বিয়ে করলেই তো হতো। যত্তো সব অর্বাচীন প্রশ্ন। কন্যার অন্য নাম ছিল ন্যাস। গচ্ছিত রাখা। অন্যের সম্পত্তি পিতার কাছে গচ্ছিত। আমি প্রাচীন শাস্ত্রমতে মেয়েদের মন্ত্রপাঠের অধিকার মেনে বিয়ে দেব আবার একটা আস্ত নিয়ম ছেঁটে ফেলব, এ রকম হয় নাকি? এ তো দুই নৌকোয় পা দিয়ে চলা,” বলছেন নৃসিংহবাবু।
ঐতিহ্য এবং আধুনিকতা... দু’নৌকোয় টালমাটাল হওয়াটাই বোধ হয় একুশ শতকের মধ্যবিত্ত হিন্দু বাঙালির বৈশিষ্ট্য। ঋকবেদ এবং নারীবাদ, রিসর্ট এবং যজ্ঞবেদী, মুম্বই-কলকাতা-দিঘা সবই আলতো ভাবে পরস্পরকে ছুঁয়ে থাকে, এক রীতি থেকে উঠে আসে আর এক রীতি। সেখানেই নন্দিনী, রুমাদের উজ্জ্বল উদ্ধার! |
|
|
|
|
|