সম্পাদক সমীপেষু...
খামকা বয়স্কদের এত গালিগালাজ কেন
কথা ঠিকই, বর্তমান প্রজন্মের পিতামহ মাতামহরা প্রচুর সন্তানের জন্ম দিতেন এবং তাদের লালনপালনে ততটা যত্নবান হতেন না। তাঁদের সন্তানসন্ততিরা, অর্থাৎ বর্তমান প্রজন্মের পিতা-মাতারা বেশির ভাগই কিন্তু একটি বা দু’টি সন্তান জন্ম দিয়েছেন। তাঁরা কোনও মতে চাকরিবাকরি জুটিয়ে পায়ের নীচে মাটি পাওয়ার চেষ্টা করে গেছেন সারা জীবন। বৃদ্ধ বাবা-মা’কে দেখে, ভাইকে পড়িয়ে, বোনের বিয়ে দিয়ে, বাড়ি ও অফিসের ঝামেলা সহ্য করে সন্তানদের প্রাণপণ মানুষ করার চেষ্টা করে গেছেন। আবার বহু মেধাবী ছাত্র নকশাল আন্দোলনে কেরিয়ার নষ্ট করেছেন। কত জন আবার শুধু কবিতা, শিল্প বা ভালবাসার জন্য কত বিনিদ্র রজনী কাটিয়েছেন।
হ্যাঁ, অনেকেই সন্তানদের সামনে বড় কিছু আদর্শ রাখতে পারেননি, কেউ বা হয়তো টুকটাক ঘুষ খেয়েছেন, ইতি-উতি মিথ্যে বলেছেন, গোধরা বা ইমার্জেন্সি নিয়ে পথে নামেননি, সমাজকে সৎ রাজনীতিবিদ উপহার দিতে পারেননি। তবু তাঁদের ছেলেমেয়েগুলো অনেকেই পড়াশুনো দিল্লি-বেঙ্গালুরু, লন্ডন-আমেরিকা পাড়ি দিচ্ছে। যারা ততটা পারেনি, তারাও বাস্তববাদী, সংবেদনশীল, পরিশ্রমীও বটে। রেলওয়ে প্ল্যাটফর্মের সংসার বা খালধারের কলোনি থেকে এক প্রজন্মে লাফটা খুব কম হল কি? দু-চার জন বখাটে, নিষ্কর্মা ছেলেমেয়ে সব প্রজন্মেই থাকে, তাদের কথা বাদ দিন।
এই পিতামাতারা বয়সের ধর্মে আজ ‘ছিনিয়র ছিটিজেন’ (রাজা ভট্টাচার্য, রবিবাসরীয়, ২৪-১১)। তাঁদের মধ্যে সুবিধাবাদী, দুর্নীতিগ্রস্ত, শয়তান বৃদ্ধরাও আছেন বইকী। তা সে কোন প্রজন্মে নেই! ও ভাবে ক’জনকে ধরে নিয়ে এমন একটা সিরিয়াস বিষয়ে আলোচনা হয় নাকি?
শুধু বয়স দেখে অহেতুক সম্মান না-ই বা দিলেন, কিন্তু বয়স্কদের অভিজ্ঞতাকে গুরুত্ব দিতে ক্ষতি কি? তাঁদের সংগ্রাম থেকে বা ভালবাসা থেকে যদি কিছু পাওয়া যায়, তা নেবেন না কেন? অবশ্যই কিছু সচ্ছল সক্ষম বয়স্ক ব্যক্তি যে সিনিয়র সিটিজেনের সুবিধা ভোগ করছেন, তা বেআইনি না হলেও হয়তো অনৈতিক। কিন্তু যে সমস্ত অশক্ত অসমর্থ প্রবীণপ্রবীণারা ট্রেনে-বাসে ওঠেন, তাঁদের জন্য দু’চারটে সিট আলাদা রাখলে ক্ষতিটা কী? আর সবাই তো সব কিছু সামলে যথেষ্ট টাকাপয়সার ব্যবস্থা করে উঠতে পারেননি। ব্যাঙ্কের সুদই যাঁদের নির্ভর, তাঁদের হাফ পার্সেন্ট ইন্টারেস্ট বাড়ালে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে?
বার্ধক্য, যৌবন বা শৈশব সবার সব কালে এক রকম যায় না। এক কালে বসে অন্য কালের সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে একটা ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ লাগে। সেটা হয় না বলেই হয়তো এত জেনারেশন গ্যাপ, যার মধ্যে অনেকটাই ঢুকে থাকে একে অপরের প্রতি অজ্ঞানতা ও অবিচার।


সত্তর দশকের উত্তাল সময়ে যাঁরা বিপ্লবী আন্দোলনের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলেছিলেন, রাজাবাবু তাঁদের ‘টিপিকাল সেয়ানা’ বলেছেন। ওই আন্দোলন পথভ্রষ্ট ছিল কি না, সে-সব প্রশ্ন না তুলে যাঁরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, তাঁরাও কিন্তু এখন ষাটোর্ধ্ব। আর, অনেকে আন্দোলনকে সমর্থন করলেও পারিবারিক দায়িত্ববোধেই এগোতে পারেননি। তাঁরা নিজের ‘কেরিয়ার’ বিসর্জন দিয়েও চেষ্টা করেছেন টিউশন করে, বা সামান্য একটা চাকরি জুটিয়ে নিয়ে দেশভাগের বলি হয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেয়ে যাওয়া বাবার পাশে দাঁড়াতে, অবিবাহিত বোনটাকে পাত্রস্থ করতে, ভাইদের মানুষ করতে। তাঁরা টিপিকাল সেয়ানা?
আজ যাঁরা ষাটোর্ধ্ব, তাঁদের অনেকেই সন্তানের ‘কেরিয়ার’ নিয়ে ভেবেছেন। এতে অন্যায়টা কোথায়? এ তো বাঙালি হৃদয়ের চিরন্তন চাওয়া। ঈশ্বর পাটনীর কথা মনে নেই?
বরং আজ জীবনসায়াহ্নে এসে ষাটোর্ধ্বরা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখছেন যে, শিব গড়তে গিয়ে তৈরি হয়েছে এমন এক স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক প্রজন্ম, যাঁরা বয়স্কদের এই আত্মত্যাগের কোনও মূল্যই দেয় না। মানবিক মূল্যবোধেরও কোনও তোয়াক্কাও করে না। বাসে বা মেট্রোয় সিট ছেড়ে দেওয়ার সৌজন্যটুকুও দেখানো তো দূরে থাক, বয়স্কদের বিজয়ার প্রণাম করা কিংবা বৃদ্ধ বাবা দু-হাতে বাজারের থলে নিয়ে সিঁড়ি ভেঙে উঠছে দেখেও নির্বিকার চিত্তে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়া, সংসারের যাবতীয় কাজকর্মগুলো বৃদ্ধ বাপ-মা’র পরেই সঁপে দেওয়া, এমনকী একসঙ্গে কাছে-দূরে কোথাও ঘুরতে গেলে বাবা-মায়ের ব্যাগটা তাঁদেরই বইতে বাধ্য করা এ সব দৃশ্য আজ ঘরে ঘরে।


তরুণ বয়সে শুনতাম, ‘শৈশবে জাপান, যৌবনে আমেরিকা এবং বার্ধক্যে ভারতে’ যেন জীবন কাটাতে পারি। অর্থাৎ, বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি যে নম্র আচরণ এবং শ্রদ্ধা এ দেশে দেখানো হয়, তা অন্যত্র বিরল। আর আজ? নানা কুশিক্ষার ফলে তরুণরা অনেকে বিকৃত চিন্তা ও উদ্ধত আচরণের শিকার। ফলে এদেরই একটা অংশ নিজ নিজ ব্যর্থতার জন্য বয়োজ্যেষ্ঠদের দায়ী করে এবং ভবিষ্যৎ জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে ব্যর্থ হলে পিতা-মাতা বা পূর্বপুরুষকে দোষী সাব্যস্ত করে।


নিশ্চিত ভাবেই বুড়োগুলো ভীষণ বদমায়েশ। এঁদের কোনও প্রকার দয়াদাক্ষিণ্য, সৌজন্য-শ্রদ্ধা দেখানোর দরকারই নেই। পরবর্তী প্রজন্ম এটা বোঝে বলেই তো আজকালকার বুদ্ধিমান ছেলেমেয়েরা বাপ-মায়ের খোঁজ রাখে না। যারা দায়ে পড়ে বৃদ্ধ-অশক্ত-অসুস্থ বাবা-মা’র খোঁজ নেয়, তারাও সম্ভবত মনে মনে বলে, ‘এ আপদগুলো গেলেই বাঁচি।’ অবশ্য এখনও মুষ্টিমেয় কিছু বোকা-সোকা, গুড বয় আছে, যারা ‘আমার বাবা’ ‘আমার মা’ বলে হেদিয়ে মরে। অমন দু-চারটে সব যুগেই থাকে।


রাজা ভট্টাচার্য লিখিত প্রবন্ধ পাঠ করে মনে হচ্ছে, ষাটোর্ধ্ব মানুষ হিসেবে এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার মতো চরম বিড়ম্বনা আর কিছু হয় না। কোনও কোনও ষাটোর্ধ্ব মানুষ অনেক গর্হিত কর্ম করেছেন, সুতরাং লেখকের ভাবনায় ‘ছিনিয়র ছিটিজেন’ মাত্রেই ঘৃণার পাত্র, সমাজের জঞ্জাল তাঁরা। আজ যাঁরা তরুণ, তাঁরাও অবশ্য একদিন ‘ছিনিয়র ছিটিজেন’রূপী জঞ্জাল হিসেবে এই পৃথিবীকে ভারাক্রান্ত করার অংশীদার হবেন। তাঁদের আগাম শুভেচ্ছা জানাই।


রাজা ভট্টাচার্য লিখেছেন, ‘দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ এঁরা কেবল বিছানাতেই লড়ে গেলেন...।’ নতুন প্রজন্ম কোথায় না লড়ছেন? বিছানায় তো
বটেই, মাঠে, ঘাটে, ময়দানে, গাড়িতে, লিফটে, সর্বত্র। মাতামহ, পিতামহ এক জনকে নিয়েই লড়েছেন। এই প্রজন্মের খ্যাতনামাদের তো হিসেবেই থাকে না।
ইতিহাসের পৃষ্ঠা থেকে লেখক অনেক সিনিয়রদের তুলে এনেছেন, যাদের কুকীর্তি আমরা ভুলতে চাই। কিন্তু ভুলে গেছেন সেই হিটলারদের, সাদ্দামদের, যাঁরা মধ্যবয়সেই পৃথিবীকে নরকের দিকে ঝুঁকিয়ে দিয়েছিলেন।
ইমার্জেন্সি, নকশাল আন্দোলন ইত্যাদি ঘটনার কালে কার ঘরের সিনিয়ররা কী ভূমিকা নিয়েছিলেন, সেই আলোচনা ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে আবদ্ধ রাখাই ভাল। আমাদের অনেকের পিতামহ, মাতামহ, পিতা, মাতা যাঁরা বাস্তুভিটা ছেড়ে এ পারে এসেছেন, অনেক সন্তানের মুখে অন্ন তুলে দিয়েছেন, তাঁদের মানুষ করার চেষ্টা করেছেন আমাদের কাছে তাঁরা নমস্য।


২০৫০ সাল নাগাদ দেশে ‘ছিনিয়র ছিটিজেন’ মানুষের সংখ্যা দাঁড়াবে ত্রিশ কোটির বেশি। এই ‘ছিটিজেন’দের হত্যালীলায় মেতে উঠলে কেমন হয়? তা হলে বাসে-ট্রামে একটু জাঁকিয়ে বসে থাকার প্র্যাকটিস করতে পারবেন।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.