চার রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে জাতীয় বিরোধী দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সাফল্য দলের সমর্থকদের উজ্জীবিত করিয়া থাকিবে। কংগ্রেসের ক্ষতি মানেই বিজেপির লাভ, এমন একটা দ্বিমুখী রাজনৈতিক সমীকরণের অঙ্ক তাঁহাদের পক্ষে নিশ্চয়ই উৎসাহজনক। তবে ঈষৎ গভীর ভাবে দেখিলে দেখা যাইবে, বিজেপি প্রত্যাশার বাহিরে কোনও সাফল্য অর্জন করিতে পারে নাই। মধ্যপ্রদেশ এবং ছত্তীসগঢ় বহু কালই বিজেপির শক্ত ঘাঁটি। রাজস্থানে বিদায়ী গহলৌত সরকারের আগে বিজেপির বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়াই মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তিনি স্বপদে পুনর্বহাল হইতেছেন মাত্র। তুলনায় দিল্লির ফলাফল বরং একেবারেই আশানুরূপ নয়। এখানে কংগ্রেস পর্যুদস্ত হইলেও তাহার সুফল বিজেপি নয়, সদ্যোজাত ‘আম আদমি পার্টি’ ঝুলিতে ভরিয়াছে।
এই ভোটপর্বে অতএব বিজেপির সাফল্যকে চমকপ্রদ বলা কঠিন। দলের শীর্ষ নেতৃত্বও নিশ্চয় সে বিষয়ে সম্যক অবহিত। তাঁহাদের মধ্যে তাই তত কিছু উচ্ছ্বাস দেখা যায় নাই। নরেন্দ্র মোদীকে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী করিয়া ভোট-প্রচারে যাওয়ার পরিণামও যে ‘মোদী-ঝড়’-এ রূপান্তরিত হইয়াছে, অন্তত এই ফলাফলে তাহার বিশেষ প্রমাণ মেলে নাই। উপরন্তু ষোড়শ লোকসভা নির্বাচনে যে সব রাজ্য হইতে বিজেপিকে পর্যাপ্তসংখ্যক সাংসদ সংগ্রহ করিতে হইবে, হিন্দি বলয়ের সেই প্রদেশগুলিতে বিজেপির সম্ভাবনা সংশয়াচ্ছন্ন। মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ় কিংবা রাজস্থানে বিজেপি কংগ্রেসের সহিত দ্বিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন ছিল, ভোটদাতাদের সেখানে রায় দিতে কোনও দ্বিধা হয় নাই। কিন্তু উত্তরপ্রদেশ, বিহারের মতো রাজ্যে সেই প্রতিযোগিতা প্রায়শ ত্রিমুখী বা চতুর্মুখী এবং অনেক আসনেই বিজেপি চতুর্থ স্থানের দাবিদার, কোথাও কোথাও তৃতীয় স্থানের জন্য লড়াই করিবে। কারণটি সহজ। এই সব রাজ্যে সমানে সমানে পাল্লা দিতে নির্বাচনী রাজনীতির মঞ্চে বহু কালই হাজির আঞ্চলিক, প্রাদেশিক, জাতপাত, খণ্ডজাতীয়তার দলগুলি। উত্তরপ্রদেশে মুলায়ম সিংহ যাদবের সমাজবাদী পার্টি, মায়াবতীর বহুজনসমাজ পার্টি, অজিত সিংহের জাঠ-প্রধান লোকদল কিংবা বিহারে নীতীশ কুমারের সংযুক্ত জনতা, লালুপ্রসাদ ও রামবিলাস পাসোয়ানের নিজস্ব সংগঠনের মহড়া লইতে হইবে বিজেপিকে। বিন্ধ্যাচলের দক্ষিণে এবং রাজমহল পাহাড়ের পূর্বে আর্যাবর্তের এই দল কোনও কালেই সুবিধা করিতে পারে নাই। ব্যতিক্রম ছিল কর্নাটক, তাহাও বর্তমানে কংগ্রেসে আস্থা ফিরাইয়াছে। তামিলনাড়ু, পশ্চিমবঙ্গ ও অন্ধ্রপ্রদেশের মতো বড় রাজ্যে বিজেপি কার্যত অস্তিত্বহীন, ওই সব প্রদেশ হইতে সাংসদ সংগ্রহ দুঃসাধ্য। কেবল অসমে অগপ’র সহিত বোঝাপড়া করিয়া কয়েকটি আসন মিলিতে পারে। ষোড়শ লোকসভায় বিজেপির গরিষ্ঠতা লাভ সহজ নহে।
বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এই সমস্যা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। পাঁচ মাসের মধ্যে পরিস্থিতি নির্ণায়ক ভাবে তাঁহাদের দিকে না ঘুরিলে কেন্দ্রে দলের সরকার গড়ার সম্ভাবনা সুদূর হইতে পারে। কংগ্রেসের শক্তিক্ষয় লইয়া কোনও সংশয় নাই। কিন্তু এই ক্ষয় বিজেপি অপেক্ষাও আঞ্চলিক দলগুলির পালে অনুকূল বাতাস প্রবাহিত করিতে পারে। তৃণমূল কংগ্রেস, বিজু জনতা দল, সমাজবাদী পার্টি, সংযুক্ত জনতা, বহুজন সমাজ পার্টি, জগন্মোহনের ওয়াইএসআর কংগ্রেস, ডিএমকে-এডিএমকে, তেলুগু দেশম প্রভৃতি দল বেশ কিছু আসন দখল করিতে পারে। এই সব দলের অধিকাংশই নরেন্দ্র মোদী নিয়ন্ত্রিত বিজেপির সহিত জোটবদ্ধ হইতে সম্মত হইবে কি না, বলা কঠিন। ভারতীয় জনতা পার্টি কী ভাবে এই ধরনের পরিস্থিতির মোকাবিলা করে, তাহা হয়তো এই দলের পরবর্তী বিবর্তনের একটি প্রধান নির্ণায়ক হইয়া উঠিবে। ভারতীয় গণতন্ত্রের পক্ষেও তাহা মূল্যবান। |