আতঙ্কে ঝরে রক্তঘাম, বিরল রোগ কিশোরীর
রীর চুঁইয়ে রক্ত ঝরে। ঘাম-রক্ত!
যুদ্ধ শুরুর আগে মৃত্যুর আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন এক সৈনিকের গা-বেয়ে গড়িয়ে পড়ে ঘাম-রক্ত। লিওনার্দো দা ভিঞ্চির আঁকা ছবিতে সেই দৃশ্য ধরা আছে। হাওড়ার চ্যাটার্জিহাটের ষষ্ঠ শ্রেণির মেয়েটির ঘটনাটা একেবারে বাস্তবের। কোনও কারণে তীব্র মানসিক উদ্বেগ হলে অথবা ভয় পেলেই মেয়ের কপাল, গাল, হাতের কনুই বেয়ে ঘামের সঙ্গে গড়িয়ে পড়ে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত। উদ্বেগ কেটে গেলে মেয়ে তখন স্বাভাবিক।
চিকিৎসকদের কাছে অবশ্য এর বেশি নজির নেই। তাঁরা জানিয়েছেন, ১৯৫২ থেকে এ পর্যন্ত বিশ্বের নানা প্রান্তের ‘মেডিক্যাল লিটারেচার’ থেকে সাকুল্যে এমন রোগীর সন্ধান মিলেছে ২০-২৫টি। যার মধ্যে ভারতে পাঁচটি। পাকিস্তান থেকে প্রকাশিত ‘জার্নাল অব কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনস’-এর চলতি বছরের এপ্রিল সংখ্যায় কোয়েটা অঞ্চলের এক মহিলার এমন একটি রোগের কথা মেডিক্যাল রিপোর্টে তুলে ধরা হয়েছে। সম্প্রতি ডোমিনিকান রিপাবলিকের এক তরুণী, বছর উনিশের ডেলফিনা সেডেনোরও একই লক্ষণ ধরা পড়ে। তাঁরও প্রথম দিকে ঘামের সঙ্গে রক্ত গড়িয়ে পড়ত। তার পর ধীরে ধীরে নখ, নাভি এমনকী চোখ থেকেও বেরোতে শুরু করে রক্ত। ডেলফিনার ঘটনা মনে করিয়ে দিতে পারে জেমস বন্ড সিরিজের প্রথম ছবি ‘ক্যাসিনো রয়্যাল’-এর খলনায়ক ‘লে শিফ্রের’ কথা। তাঁরও চোখ থেকে বেরোত রক্তঅশ্রু। তবে শিফ্রের চোখে সমস্যা ছিল। কিন্তু হাওড়ার কিশোরী কিংবা ডেলফিনার ক্ষেত্রে বিষয়টি তা নয়। ডাক্তাররা জানাচ্ছেন, চরম মানসিক দুশ্চিন্তা থেকেই রক্তজালিকা ফেটে ঘামের সঙ্গে রক্ত ঝরে, চিকিৎসা পরিভাষায় যাকে বলে, ‘হেমাটোহাইড্রোসিস।’ এবং এই রোগ জিনগত নয়।
ঘামের সঙ্গে রক্ত বেরিয়ে আসছে ছোট্ট মেয়ের।—নিজস্ব চিত্র।
হাওড়ার কিশোরীর ক্ষেত্রে অবশ্য বিষয়টি নজরে আসে গত বছর। তার বাবার কথায়, “দিনটা ছিল ২০১২ সালের লক্ষ্মীপুজোর পরের দিন। কী একটা কারণে ওকে একটু বকেছি। দেখি, ও কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেল! ওর জুলফির পাশ দিয়ে গলগল করে ঘাম ঝরছে। সঙ্গে মিশে রয়েছে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত।”
সেই শুরু। ঘামের সঙ্গে রক্ত পড়লেই তাঁরা বুঝতে পারেন মেয়ে কোনও কারণে উদ্বিগ্ন, অথবা ভীষণ ভয় পেয়েছে। এমন ঘটনা সপ্তাহে ২০-২৫ বার করেও হয়েছেজানায় ছাত্রীর পরিবার। মায়ের অভিযোগ, “জন্ম থেকে এমন ছিল না আমার মেয়ে। ও পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ত হাওড়ারই অন্য একটি স্কুলে। সেখানকার এক দারোয়ান দিনের পর দিন ছুটির পরে ফাঁকা স্কুল বাড়িতে ওকে যৌননিগ্রহ করত। এ কথা কাউকে জানালে মেরে ফেলার হুমকিও দিত। এই ভয়ে ও কোনও দিন আমাদের কিছু জানায়নি। অথচ দেখতাম, মেয়েটা কেমন চুপচাপ হয়ে যাচ্ছে, আচরণও বদলে যাচ্ছে। তার পর থেকেই ওই রক্ত পড়া শুরু।”
যৌননিগ্রহের কথা মেয়েটি প্রথম জানায় এসএসকেএম হাসপাতালের চিকিৎসকদের। কয়েক মাস ধরে এমন হচ্ছে দেখে গত ফেব্রুয়ারিতে এই হাসপাতালের ত্বক বিভাগে মেয়েকে নিয়ে আসেন বাবা-মা। এক সপ্তাহ ‘নজরদারি’-তে রেখে যাবতীয় পরীক্ষার পর ছাত্রীটিতে পাঠানো হয় ‘ইনস্টিটিউট অব সাইকিয়াট্রি’ (আইওপি) বিভাগে। সেখানেই ‘সাইকোলজিক্যাল ইভ্যালুয়েশন’ বা মনোবৈজ্ঞানিক পরীক্ষা করে মেয়েটির রক্তক্ষরণের আসল কারণ ধরা পড়ে। চিকিৎসকেরা জানান, মাত্রাছাড়া মানসিক উত্তেজনা ও ভয়ে কোনও কোনও মানুষের দেহের সূক্ষ্ম রক্তজালিকা (ক্যাপিলারি ব্লাড ভেসেলস) ছিঁড়ে যায়। সেখান থেকে নির্গত রক্ত ঘামের সঙ্গে মিশে চামড়ার উপরে থাকা ছিদ্র দিয়ে চলে আসে বাইরে।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মেয়েটির কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করেন। সেখানেই উঠে আসে তার উপর যৌননিগ্রহের তথ্য এবং তার থেকে উদ্বেগ ও ভয় পাওয়ার ছবিটা। কিন্তু তখন কেন ওই দারোয়ানের বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে অভিযোগ জানালেন না? জবাবে বাবা বলেন, “সবাই বলল, থানা-পুলিশ করলে আখেরে মেয়েরই দুর্নাম হবে। ও স্বাভাবিক জীবন কাটাতে পারবে না। তাই থানায় না গিয়ে ওর চিকিৎসাতেই মন দিলাম। মাঝে এক বার বেঙ্গালুরুর নিমহ্যানস হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলাম। লাভ হয়নি। তাই এখানে এনেছি।”
কী বলছেন ছাত্রীর চিকিৎসকেরা? এসএসকেএমের ত্বক বিভাগের প্রধান গোবিন্দ চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, “আমার দীর্ঘ পচিশ বছরের চিকিৎসক জীবনে এই রকম দু’টি ঘটনা দেখলাম। এমন একটি ঘটনা বছর চারেক আগে দেখেছি আরজি কর হাসপাতালে। রোগটা মূলত অত্যধিক মানসিক চাপ থেকে হয়।” ইনস্টিটিউট অব সাইকিয়াট্রি-র চিকিৎসক সুজিত সরখেলের ব্যাখ্যা, মানুষের ত্বকের নীচের অংশটিকে ‘ডারমিস’ এবং উপরের অংশটাকে ‘এপিডারমিস’ বলে। কোনও কারণে ভয় পেলে এপিডারমিসের রক্তজালিকাগুলি সঙ্কুচিত হয়ে যায়। পরমুহূর্তে জালিকাগুলি আবার যখন প্রসারিত হয়, তখন কিছু ক্ষেত্রে তা ফেটে রক্ত বেরিয়ে আসতে পারে। সেই রক্তই ঘামের সঙ্গে বেরিয়ে আসে।
কারণ, ঘর্মগ্রন্থি আর রক্তজালিকা পাশাপাশি থাকে।
ইনস্টিটিউট অব সাইকিয়াট্রি (আইওপি)-তেই এখন চিকিৎসা চলছে মেয়েটির। চিকিৎসকদের দাবি, অনেকটাই সুস্থ হয়েছে সে। মাসে এখন হয়তো এক বার ঘামের সঙ্গে রক্ত বের হয়, তাও সামান্য। আইওপি-র ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট প্রশান্তকুমার রায়ের কথায়, “সম্ভবত যৌন হেনস্থা থেকেই মেয়েটির মনের ভিতর এত মারাত্মক ভয় জমেছিল যে সে সেই চাপ নিতে পারছিল না। বাড়িতে বাবা-মায়ের সামান্য বকুনিতেই উদ্বেগ বেড়ে তার রক্তজালিকা ফেটে যেত এবং ঘামের সঙ্গে রক্ত বেরিয়ে আসত। এই রোগের কারণেই মেয়েটি মাঝে মধ্যে অজ্ঞান হয়ে যায়, ভুল বকে।” মনোবিজ্ঞানের পরিভাষায় যে সব উপসর্গকে ‘ট্রান্স অ্যান্ড পজেশন ডিসঅর্ডার’ নামে অভিহিত করা হচ্ছে। চিকিৎসকদের মতে, এই মানসিক সমস্যা কিংবা শরীর থেকে রক্তঘাম বেরোনো, দুই-ই আসলে দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা ভয়, উদ্বেগের বহিঃপ্রকাশ। তবে ডাক্তাররা এ-ও জানান, এই রোগে সাধারণ কারণে ঘাম হলে কোনও রক্তক্ষরণ হয় না।
চিকিৎসকদের কথায়, ক্রমশ সুস্থ হয়ে উঠছে মেয়েটি। কিন্তু কিশোরীর রক্তঘাম নিয়ে স্কুল থেকে এলাকার টিকা-টিপ্পনি চলছেই। মায়ের কথায়, প্রথম দিকে স্কুলে সকলে ভাবত মেয়ের বুঝি কোনও খারাপ রোগ হয়েছে। ওকে স্কুলে পাঠানো উচিত নয় বলেও মত দেওয়া হত। পরে চিকিৎসার যাবতীয় কাগজপত্র দেখানোয় এখন অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। পাড়াতেও এই নিয়ে নানা লোকের নানা কথা, কৌতূহল!”
মেয়ে অবশ্য এখন আর এ সব নিয়ে ভাবছেই না। তার কথায়, “ডাক্তারকাকুরা বুঝিয়েছেন আমি মা দুর্গার অংশ। ইচ্ছা করলে মহিষাসুরের মতো সব বদমাইশ লোককে মেরে ফেলতে পারি। আগের স্কুলের খুব খারাপ দারোয়ানজিকে মারার মতো জোর-ও আমার আছে। তাই আমার এখন আর অত ভয় করে না।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.