দক্ষিণ-পূর্ব রেলের চতুর্থ শ্রেণির কর্মী নিয়োগের পরীক্ষা আজ, রবিবার। আর ঠিক তার আগের দিনই হদিস মিলল এক জালিয়াতি চক্রের।
শনিবার ভোরে হাওড়ার জগাছায় হানা দিয়ে এক রেলকর্মী-সহ চার জনকে গ্রেফতার করেছে রেলের ভিজিল্যান্স দফতর ও পুলিশ। বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে নগদ ৪ লক্ষ ৬৩ হাজার টাকা, একটি ট্যাবলেট কম্পিউটার, ফটোকপি মেশিন, স্ক্যানার এবং ৭১টি মোবাইল ফোন। ধৃতদের কাছ থেকে কিছু কাগজপত্রও উদ্ধার করা হয়েছে। প্রাথমিক ভাবে পুলিশের অনুমান, ওই কাগজের মধ্যে রয়েছে রেলেরই আগে হয়ে যাওয়া কোনও একটি পরীক্ষার উত্তরপত্র। সেটি অভিযুক্তেরা কী ভাবে কাজে লাগাত, সে সম্পর্কে পুলিশ এখনও নিশ্চিত হতে পারেনি।
তবে দক্ষিণ-পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক সৌমিত্র মজুমদার জানিয়েছেন, এখনও পর্যন্ত এমন কিছু পাওয়া যায়নি, যাতে পরীক্ষা বাতিল করতে হতে পারে। তাই এই ঘটনায় পরীক্ষার সূচিতে কোনও হেরফের হবে না। আজ, রবিবার পূর্ব নির্ধারিত সূচি অনুযায়ী পরীক্ষা হবে।
রেল জানিয়েছে, ধৃতদের মধ্যে রয়েছে রেলের সহকারী চালক জয়প্রকাশ গুপ্ত। বাকিরা হল মনোজ সিংহ, বিনোদ প্রসাদ এবং আনন্দ চক্রবর্তী। চার জনেই আদ্রার বাসিন্দা। বিনোদ ও আনন্দ এই চক্রে দালালের কাজ করত। এই ঘটনায় মূল চক্রী হিসেবে বার্নপুরের এক ব্যক্তির কথা জানতে পেরেছেন তদন্তকারীরা।
এ দিন হাওড়ার বিভিন্ন হোটেল থেকে ৮০ জন পরীক্ষার্থীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তাঁদের বেশির ভাগই পুরুলিয়ার বাসিন্দা বলে রেল সূত্রের খবর। এ বিষয়ে রেল-প্রতিমন্ত্রী অধীর চৌধুরী বলেন, “রেলের ভিজিল্যান্স দফতর ফাঁদ পেতে এই চক্রের সঙ্গে জড়িতদের পাকড়াও করেছে। অভিযানে যুক্ত অফিসারদের পুরস্কৃত করা হবে। প্রয়োজনে তদন্তে সিবিআই-এরও সাহায্য নেওয়া হবে।”
রেল জানিয়েছে, দক্ষিণ-পূর্ব রেলে ২৪০০ চতুর্থ শ্রেণির কর্মী নিয়োগের জন্য এই পরীক্ষা। নিয়োগের জন্য ‘রেলওয়ে রিক্রুটমেন্ট সেল’ মাস কয়েক আগে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। পরীক্ষার্থী প্রায় ছ’লক্ষ। বিপুল সংখ্যক পরীক্ষার্থী সামাল দেওয়ার জন্য পাঁচ দফায় পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন রেলকর্তারা। গত নভেম্বর থেকে প্রতি রবিবার পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে। চার দফায় পরীক্ষা হয়ে গিয়েছে। আজ, রবিবার পঞ্চম ও শেষ দফা। সৌমিত্রবাবু বলেন, “আজ, রবিবার কলকাতার পূর্ব নির্ধারিত ৪৮টি কেন্দ্রে পরীক্ষা দেবেন ৮০০০০ পরিক্ষার্থী।”
কী ভাবে ধরা পড়ল এই চক্র?
রেল সূত্রের খবর, টাকার বিনিময়ে পরীক্ষার উত্তরপত্র মিলছে বলে শুক্রবার তাদের কাছে খবর এসেছিল। সন্দেহভাজন এক ব্যক্তির বিবরণও মেলে। তার পরেই ভিজিল্যান্স দফতরের অফিসারেরা বিভিন্ন সূত্রে জানতে পারেন, খড়্গপুর থেকে এই চক্রের চাঁই হাওড়ায় আসছে। সেই মতো একটি দল খড়্গপুরে পৌঁছে যায়। তাঁরা দেখেন, সন্দেহভাজন ওই ব্যক্তি হাওড়ামুখী রূপসী বাংলা এক্সপ্রেসে উঠেছেন। পিছু নেয় ওই দলটি। সাঁত্রাগাছি স্টেশনে নেমে যান ওই ব্যক্তি। সেখানেও তাঁর পিছু নেন ভিজিল্যান্স দফতরের অফিসারেরা।
সাঁত্রাগাছি স্টেশন থেকে বেরিয়ে ওই ব্যক্তি জগাছা এলাকার নয়াবাজে একটি বহুতলে ঢোকে। এর পরেই বাড়িটি ঘিরে ফেলেন ভিজিল্যান্স অফিসারেরা। ভোরে স্থানীয় পুলিশকে নিয়ে ওই বহুতলের একটি ফ্ল্যাটে হানা দিয়ে আনন্দ চক্রবর্তী এবং জয়প্রকাশ গুপ্তকে ধরা হয়। সেখান থেকেই নগদ টাকা, ট্যাবলেট কম্পিউটার, ফটোকপি মেশিন বাজেয়াপ্ত করা হয়। ওই ফ্ল্যাটে আট জন পরীক্ষার্থীও ছিলেন বলে রেল জানিয়েছে।
ভোরেই সাঁত্রাগাছি স্টেশনের কাছে একটি হোটেলে হানা দেয় ভিজিল্যান্স-পুলিশের একটি দল। রেল সূত্রের খবর, সেখান থেকে গ্রেফতার করা হয় প্রাক্তন রেলকর্মী মনোজ সিংহকে। ওই হোটেলেও পাঁচ জন পরীক্ষার্থী ছিলেন। মনোজের কাছ থেকে হাজার দশেক টাকাও বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। এ দিন ধৃতদের পাশাপাশি ওই পরীক্ষার্থীদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন তদন্তকারীরা।
দক্ষিণ-পূর্ব রেলের ডেপুটি চিফ ভিজিল্যান্স অফিসার প্রণবকুমার নাগ বলেন, “ধৃতেরা টাকার বিনিময়ে পরীক্ষার্থীদের উত্তরপত্র বিক্রির ছক কষেছিল। এই চক্রটি আদ্রা এলাকায় সক্রিয়।” তদন্তকারীরা জেনেছেন, উত্তরপত্র দেওয়ার জন্য হাওড়া এলাকার কয়েকটি হোটেলে পরীক্ষার্থীদের জড়ো করা হয়েছিল। উত্তরপত্র বিক্রির জন্য পরীক্ষার্থী-পিছু লাখ দুয়েক টাকা নেওয়া হয়েছিল। উত্তরপত্র সংগ্রহের জন্য এ দিন হাওড়ার একটি স্কুলের কাছে পরীক্ষার্থীদের আসতে বলা হয়েছিল। চন্দন মুখোপাধ্যায় নামে এক পরীক্ষার্থী বলেন, “মার্কশিট ও রেলের পরীক্ষার অ্যাডমিট কার্ডের প্রতিলিপিও জমা নিয়েছিল ওরা।”
তদন্তকারীদের ধারণা, বাজেয়াপ্ত করা ট্যাবলেট কম্পিউটারের মধ্যে কোনও উত্তরপত্র থাকতে পারে। ফ্ল্যাটের মধ্যেই স্ক্যানার ও ফটোকপি মেশিন উদ্ধার হওয়ায় ওখান থেকেই সরাসরি উত্তরপত্র ছাপিয়ে বিলি করার ছক হয়ে থাকতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। ট্যাবলেটটির ভিতরে কী রয়েছে, তা পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে বলে রেল সূত্রের খবর। |