সবে গেল বর্ষা। প্রাচীন মফস্সল শহর নবদ্বীপের নর্দমা, রাস্তাঘাটের জমা জলে ভেসে যায় মঠ-মন্দিরের চাতাল। পথের ধারের রোয়াকে তখন হাঁটুজলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলেন ওঁরা।
এসে পড়ল শীত। পৌষ-মাঘের শেষরাতে কুড়ানো কাঠকুটোর আগুনও নিভে যাবে। একটু উষ্ণতার খোঁজে তখন ওঁরা ডেকে নেবেন পথের কুকুরকে। ছেঁড়া চটের বিছানায় ঘন হয়ে শুয়ে থাকা কুকুরের গায়ের ওমে কাটাবার চেষ্টা রাতটুকু। বৈষ্ণবতীর্থ নবদ্বীপের দেড় শতাধিক মঠ-মন্দিরের খোলা চাতাল বা পথের ধারের রোয়াকগুলোই হাজার তিনেক বিধবার ‘বার্ধক্যের বারাণসী’।
সম্প্রতি সিপিআই সাংসদ গুরুদাস দাশগুপ্ত কাশী ও বৃন্দাবনের বিধবাদের দুরাবস্থার কথা প্রধানমন্ত্রীকে লিখেছেন। ওই দুই তীর্থের অনাথ বিধবাদের জন্য দেশের প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিনা ব্যয়ে চিকিৎসা, আশ্রয় সহ বেশ কিছু বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু নবদ্বীপের অনাথ বিধবারা অন্তরালেই থেকে গিয়েছেন। প্রবীণ নাগরিকদের জন্য বরাদ্দ সরকারি সুযোগ সুবিধা বহু দূরের কথা, দু’বেলা খাওয়া, মাথার উপরে একটা ছাদও জোটে না তাঁদের।
পরিবার-পরিত্যক্ত এই মহিলাদের অসুখ-বিসুখে ভরসা দাতব্য হোমিওপ্যাথ পুরিয়া। ভাগ্যক্রমে কেউ ঠাঁই পান নবদ্বীপ স্টেট জেনারেল হাসপাতালে। যতদিন শরীরে ক্ষমতা থাকে ততদিন লোকের বাড়ি বাসন মেজে, বা কোনও মঠ-মন্দিরে, দোকান-হোটেলে কাজের বিনিময়ে দু’বেলা পেটের ভাতের ব্যবস্থা করে নেন ওই বৃদ্ধারা। তারপর বয়স বাড়ে, ছুটি হয়ে যায় সব কাজ থেকে। তখন দিনভর হরিনাম করে তোবড়ানো থালায় জুটে যায় একমুঠো ভাত, বছরে দু’একটা কাপড়-কম্বল। বিভিন্ন উৎসবের সময়ে শহরে আসা দর্শনার্থীদের দেওয়া ভিক্ষাই
ওঁদের ভরসা। |
নবদ্বীপ পঞ্চায়েত সমিতির বিশেষ আধিকারিক লক্ষীনারায়ণ প্রামাণিক বলেন, “২০০০ সালে একটি বেসরকারি সংস্থাকে দিয়ে নবদ্বীপের ওই অনাথ বিধবাদের উপর সমীক্ষা হয়েছিল। তখনই নবদ্বীপে প্রায় আড়াই হাজার অনাথ বিধবা পাওয়া যায়। তারপর সে সংখ্যাটা অনেকটাই বেড়েছে। কিন্তু ওঁদের জীবনযাপনে কোনও পরিবর্তন আসেনি।” তিনি জানান, হাজার তিনেক বিধবার মধ্যে মাত্র ১৩৭ জন রাজ্যের সমাজ কল্যাণ দফতর থেকে মাসিক ৭৫০ টাকা করে বিধবা ভাতা পান। আর ১৭৮ জন পান বার্ধক্যভাতা। বাকিদের ভিক্ষাই ভরসা।
কিন্তু শহর জুড়ে ছড়িয়ে থাকা অসুস্থ, অশক্ত কয়েক হাজার বৃদ্ধার সামগ্রিক পুনর্বাসনের জন্য নবদ্বীপের পুরপ্রশাসন কী করছে? পুরপ্রধান তৃণমূলের বিমানকৃষ্ণ সাহা জানান, দু’একটি বেসরকারি বৃদ্ধাবাস রয়েছে নবদ্বীপে। কিন্তু সেখানে কেবল সম্পন্ন পরিবারের বিধবারা থাকেন। কিছু কিছু মঠ-মন্দিরেও অর্থের বিনিময়ে থাকার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু বেশির ভাগ বিধবা যেখানে পরিবার থেকে বিতাড়িত তাদের কী উপায় হবে, এর উত্তর নেই বিমানবাবুর কাছেও। পুরসভার বাজেটে এই বিধবাদের জন্য কোনও টাকাই ধার্য নেই। বিমানবাবু বলেন, “নবদ্বীপে কোনও শিল্প নেই। কর থেকে পুরসভার অতি সামান্য আয়। আমরা রাজ্য সরকার, কেন্দ্রীয় সরকারের থেকে সাহায্য চাইছি। বৃন্দাবন ও কাশীর বিধবারা কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে সাহায্য পেলে নবদ্বীপের বিধবারা কেন বঞ্চিত হবেন? ওঁদের জন্য জমি-সহ অন্য যে কোনও সহযোগিতা করতে নবদ্বীপ পুরসভা প্রস্তুত।”
কিন্তু কেন্দ্র আর রাজ্যের রাজনৈতিক সংঘাত থেকে মুক্তি নেই এই অসহায় বৃদ্ধাদেরও। নবদ্বীপের বিধায়ক তথা রাজ্যের মন্ত্রী পুন্ডরীকাক্ষ সাহা বলেন, “এ রাজ্যের প্রতি কেন্দ্র এখন প্রতিহিংসার মনোভাব নিয়ে চলছে। রাজ্যের তরফে কী করা যায় তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”
সাংসদ গুরুদাস দাশগুপ্ত কেন বৃন্দাবনের বিধবাদের প্রসঙ্গে নবদ্বীপের বিধবাদের কথাও লিখলেন না প্রধানমন্ত্রীকে? গুরুদাসবাবু বৃহস্পতিবার বলেন, “আমি নবদ্বীপের বিধবাদের কথা জানতাম না। আমাকে তাঁদের বিষয়ে কেউ কখনও কিছু জানায়নি। আমি শীঘ্রই বিধবাদের বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে কথা বলব। তখন নবদ্বীপের বিধবাদের কথাও জানাব।” |