পনেরো কোটির পাহাড়
৪ অক্টোবর, ২০১২।
বিকেল ৬.৩০।
একটু আগেই ভেঙ্কটেশের লেক গার্ডেন্স-য়ের অফিস থেকে মিটিং সেরে বেরিয়েছেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। শ্রীকান্ত মোহতার ফোনে সে দিনের মতো অ্যাপয়েন্টমেন্ট লিস্ট খালি। এর মধ্যেই হঠাত্‌ পরিচালক কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায় ঘরের দরজাটা টোকা দিয়ে বললেন, “তোমার সঙ্গে একটা কথা ছিল শ্রীকান্ত।”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, বলুন?” এসি-টা কমিয়ে দিয়ে বলেন প্রযোজক। “‘চাঁদের পাহাড়’ বইটা আবার করে পড়লাম। এই রকম গল্প সিনেমা হওয়া উচিত। সাধে কি আর সত্যজিত্‌বাবু করতে চেয়েছিলেন!” লাজুক ভঙ্গিতে বলেন কমলেশ্বর।
সে দিনের সন্ধে ৬.৩০য়ের আড্ডা শেষ হয় রাত পৌনে দশটায়। পরের দিন সকালেই ট্রাভেলের লোকেদের ডেকে পাঠান শ্রীকান্ত। “এমিরেটস-য়ে দুটো টিকিট বুক করুন। কমলদা আর এক্সিকিউটিভ প্রোডিউসর অভিষেক দাগার। কলকাতা-দুবাই-জোহানেসবাগর্। ওঁরা রেকি করতে যাবেন আফ্রিকা।”
পরের ফোনটা যায় মহেন্দ্র সোনির কাছে। “মণি, ‘চাঁদের পাহাড়’ বনায়েঙ্গে। থোড়া ফিন্যান্স লেকে শাম কো মিটিং করনা হ্যায়।” এর পর ফোন দেবের ব্ল্যাকবেরিতে। “দেব, আজ দোপহর কো একবার অফিস আনা প্লিজ।”
শুরু হয়ে যায় টলিউডের সবচেয়ে এক্সপেন্সিভ ছবির যাত্রা।
শঙ্কর, কমলেশ্বর, আফ্রিকা, বিভূতিভূষণ পনেরো কোটি টাকার ছবি। হয়তো বা বাংলা ছবির সবচেয়ে বড় ‘গেম চেঞ্জার’ও। এবং নিশ্চিত ভাবেই এমন একটা ছবি, যা বাংলা ইন্ডাস্ট্রিকে দুই মেরুতে ভাগ করেছে।
আফ্রিকার হাতির সামনে শঙ্কর।
আমি আমার ২০০ পার্সেন্ট দিয়েছি
এই ছবিটা যিনি নিজের কাঁধে নিয়েছেন সেই দেব-ও মনে করছেন ‘চাঁদের পাহাড়’ বাংলা ইন্ডাস্ট্রিকে বদলে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।
“অবশ্যই এটা ভীষণ ইম্পর্ট্যান্ট ফিল্ম। এত বড় ছবির দায়িত্ব আমার কাঁধে এটা ভেবে যেমন আনন্দ হচ্ছে, তেমনই প্রেশারও বুঝতে পারছি। আমি আমার ২০০ পার্সেন্ট দিয়ে দিয়েছি ছবিটায়। আমি শুধু এটাই এনশিওর করতে চেয়েছি যে, ছবিটা দেখে লোকে বলুক, দেব ছাড়া আমরা শঙ্কর ভাবতেই পারি না ,” বলছেন দেব।
প্রসেনজিত্‌ চট্টোপাধ্যায় প্রায়ই একটা গল্প বলেন যে বাংলা ছবির আউটডোর বলতে এক সময় ছিল শুধু ফলতা আর গ্যাংটক।
সেই সময় হরনাথ চক্রবর্তীরা প্রচুর ছবি বানাতেন। আজ পনেরো কোটির ‘চাঁদের পাহাড়’কে তাঁরা কী ভাবে দেখেন?
“এটা একটা বিরাট জাম্প। আমি অসম্ভব গর্বিত একটা বাংলা ছবি ১৫ কোটির বাজেটে পৌঁছতে পেরেছে বলে। ‘চাঁদের পাহাড়’ চলল কি না সেটা পরের ব্যাপার। ছবিটা কিন্তু ইতিহাসে ঢুকে গেল,” বলছেন হরনাথ চক্রবর্তী।
কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায় অবশ্য এই সব নিয়ে বেশি মাথা ঘামাতে চান না। তাঁর চোখ এখন ছবির রিলিজের দিকে। তা ছাড়া তাঁর মধ্যে আর একটা বদলও চোখে পড়ার মতো। ‘মেঘে ঢাকা তারা’র আগে যেমন নার্ভাস ছিলেন, এ বারে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী দেখাচ্ছে তাঁকে। “‘মেঘে ঢাকা তারা’র ন্যারেটিভটা লিনিয়ার ছিল না। অনেকের ফলো করতে অসুবিধা হতে পারে এই রকম একটা চিন্তা ছিল। কিন্তু ‘চাঁদের পাহাড়’ একটা লিনিয়ার গল্প। আশা করছি, মানুষের আমাদের কাজ ভাল লাগবে,” বলছেন পরিচালক। অন্য দিকে ‘চাঁদের পাহাড়’ নিয়ে হাইপও তুঙ্গে। ইতিমধ্যেই ইউটিউবে এক লক্ষ আশি হাজারেরও বেশি হিটস হয়ে গিয়েছে। অন্য স্ট্যাটিস্টিক্সগুলোও চোখে পড়ার মতো।
সংখ্যায় ‘চাঁদের পাহাড়’
১৫ কোটি টাকায় বাংলার সবচেয়ে ব্যয়বহুল ছবি ‘চাঁদের পাহাড়’। আজ অবধি সবচেয়ে ব্যয়বহুল বাংলা ছবি ‘মিশর রহস্য’য়ের ঠিক দ্বিগুণ এই ছবির বাজেট। ‘চাঁদের পাহাড়’-য়ের রেকি মানে শ্যুটিংয়ের আগে ব্যবস্থাপনা দেখতেই খরচ হয়েছে ৪০ লক্ষ টাকা।
আজ অবধি যত ছবি বিদেশে শ্যুটিং হয়েছে, তার দিনের হিসেব করলেও ‘চাঁদের পাহাড়’ সবার আগে।
দু’খেপে প্রায় ৪০ দিন দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গ থেকে কালাহারি মরুভূমিতে শ্যুটিং করেছেন ‘শঙ্কর’ অ্যান্ড গ্যাং। একেক দিনের শ্যুটিংয়ের খরচেও প্রায় সবাইকে পিছনে ফেলেছে এই ছবি।
যেমন? যেমন সিংহের সঙ্গে দু’দিনের শ্যুটিংয়ের খরচ হয়েছে ৩০ লক্ষ টাকা। হাতির সঙ্গেও শ্যুটিংয়ের খরচ ২৫ লক্ষ টাকার কাছাকাছি।
এ ছাড়াও রয়েছে ৭০ জন টেকনিশিয়ানের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা। সাউথ আফ্রিকার জঙ্গলে তিন দিনের শ্যুটিংয়ে সেট তৈরি করতেই খরচ হয়েছে ২৫ লক্ষ টাকা। যখন এই স্টোরি লেখা হচ্ছে, ঠিক সেই মুহূর্তে মুম্বইয়ের তিনটে স্টুডিয়োতে ‘চাঁদের পাহাড়’-য়ের কম্পিউটার গ্রাফিক্সের কাজ চলছে পুরোদমে। ক্লাইম্যাক্সে একটি আগ্নেয়গিরির কম্পিউটার গ্রাফিক্স তৈরি করতেই খরচ হয়েছে ৪৫ লক্ষ টাকা। পুরো কম্পিউটার গ্রাফিক্স করতে আনুমানিক খরচ ২ কোটি টাকা।
এমনকী দেবজ্যোতি মিশ্রর মিউজিক ও ব্যাকগ্রাউন্ড পছন্দ না হওয়ায় ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্তকে দিয়ে নতুন করে ছবির গান ও ব্যাকগ্রাউন্ড বানানো হচ্ছে।
এই ছবির ট্রেলার দেখে বেশ আশ্চর্যচকিত হয়েছেন বলিউডের বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ তরণ আদর্শ।
“আমরা মুম্বইতে বলাবলি করছি এটা বাংলার ‘কামিং অফ এজ’ ফিল্ম। শাহরুখ, হৃতিকের যে কোনও ছবির সঙ্গে তুলনা করা যায় ‘চাঁদের পাহাড়’য়ের। শুধু একটাই আবেদন আমার, এই ছবিটা ইন্টারন্যাশনালি ভাল করে রিলিজ করুন প্রযোজকেরা,” বলছেন তরণ।
এই ছবিটা গোটা বাংলা জুড়ে একসঙ্গে ২৪০টা হলে রিলিজ করা হবে। এ ছাড়াও এই প্রথম একই দিনে আমেরিকাতেও রিলিজ হচ্ছে ‘চাঁদের পাহাড়’।কিন্তু কেন বলা হচ্ছে ‘চাঁদের পাহাড়’ গেম চেঞ্জার?

এটাই গেম চেঞ্জার
“দেখুন বাংলায় মেনস্ট্রিম সিনেমা স্ট্যাগন্যান্ট হয়ে গেছে। সেই বিদেশে শ্যুটিংয়ের দু’টো গান, ভিলেনদের নিয়ে মারামারি, এর বাইরে আমরা কিছু করতে পারছি না। এই ছবিগুলো রিলিজ হচ্ছে শহরতলিতে। কলকাতায় এদের কোনও ভবিষ্যত্‌ নেই। অন্য দিকে অন্য ধরনের যে ছবি হয়, তা কলকাতার ৫০টার বেশি হলে চলছে না। কিন্তু এই প্রথম আমরা একটা ছবি দেখতে পাচ্ছি যেটা মুর্শিদাবাদের লোকেরাও দেখতে চাইছে, আবার সাউথ সিটির মাল্টিপ্লেক্সে লোকে ফোন করে জানতে চাইছে কবে ‘চাঁদের পাহাড়’ রিলিজ করবে। এটা একটা রেভোলিউশন। এখানেই এই ছবিটা গেম চেঞ্জার। আর আমি টাকা রিকভারি নিয়ে ভাবছি না। আমরা এই ছবিটা বানিয়ে বাংলা ছবির লেভেলটা বাড়িয়ে দিলাম। এর পরে অনেকেই হয়তো এভারেস্টে চড়বে। কিন্তু তেনজিং আর হিলারিকে কেউ কি ভুলতে পেরেছে?” সাফ বলছেন শ্রীকান্ত ।
অন্য দিকে মুনমুন সেন মনে করেন ‘চাঁদের পাহাড়’ যদি টাকা তুলতে পারে, তা হলে বাংলা ছবির ভবিষ্যত্‌টাই পাল্টে যাবে। “আমি তো প্রথম দিন দেখতে যাব। ভাবা যায়, পনেরো কোটির বাংলা ছবি! তবে ‘চাঁদের পাহাড়’য়ের বক্স অফিসে সাফল্য পাওয়াটা খুব দরকার। ছবিটা না চললে ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে আমরা পিছিয়ে যাব। আর যদি টাকা তুলে নেয়, আমাদের আর আটকায় কে!” নিজস্ব ভঙ্গিতে বলেন মুনমুন সেন।
এ রকম একটা ছবির মুক্তির সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু সেই পুরনো ভেঙ্কটেশ বনাম রিলায়্যান্স কম্পিটিশনও এসে পড়ছে।
ওই একই দিনে মুক্তি পাওয়ার কথা সৃজিত মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ও প্রসেনজিত্‌ অভিনীত ‘জাতিস্মর’। একই দিনে ‘জাতিস্মর’ মুক্তি পাবে কি পাবে না, সেটা এখনও ঠিক হয়নি। যদি একই দিনে মুক্তি না পেয়ে দশ দিনের ব্যবধানেও মুক্তি পায়, সেখানেও ‘চাঁদের পাহাড়’ না ‘জাতিস্মর’ কোন ছবি এগিয়ে থাকল, সেই মহাযুদ্ধের দিকে নজর থাকবে সবার। অন্য দিকে দেব-শ্রীকান্ত যতই ‘চাঁদের পাহাড়’কে ‘গেম চেঞ্জার’ মনে করুন না কেন, প্রযোজক অশোক ধানুকা মনে করছেন, কোনও মতেই গেম চেঞ্জার নয় ‘চাঁদের পাহাড়’।
“না, না, ও সব গেম চেঞ্জার হিসেবে আমি দেখছি না ছবিটাকে। এটা একটা কস্টলি ছবি। কস্টলি বিষয়। ব্যস। এর বেশি কিছু নয়। ট্রেলারটা যদিও এক্সট্রাঅর্ডিনারি হয়েছে, কিন্তু তাতে কিছু এসে যায় না। ‘মেঘে ঢাকা তারা’র ট্রেলারও দারুণ ছিল। তবে একটা প্লাস পয়েন্ট আছে, আজ অবধি জন্তু-জানোয়ারের ছবি বক্স অফিসে ফেল করেনি। আর কমার্শিয়াল হিরো বলে দেবের একটা অ্যাপিল থাকবে।” বলছেন অশোক।
অন্য দিকে বাংলা ছবির আর এক প্রযোজক পীযূষ সাহা মনে করেন ১৫ কোটি টাকা বাজেটে এ ছবি বানানো ‘ব্যাড বিজনেস ডিসিশন’।
“ইন্ডাস্ট্রিতে ৫ কোটি টাকার ছবি রিকভারি করতে কী কাঠখড় পোড়াতে হয় আমরা জানি। সেখানে ১৫ কোটি বাজেটের ছবি বানানোর যৌক্তিকতা বুঝি না। এর থেকে ৫ কোটি টাকা দিয়ে গ্রাম-বাংলার হলে যদি ইনভেস্ট করত ভেঙ্কটেশ, সেটা টলিউডের জন্য অনেক ভাল হত,” বলছেন পীযূষ। বোঝা যায় ‘চাঁদের পাহাড়’য়ের জন্য ইন্ডাস্ট্রিতে মেরুকরণ স্পষ্ট।
অশোক, পীযূষের কথায় বিচলিত নন শ্রীকান্ত। “আমি আমার ছবির রিলিজ নিয়ে অসম্ভব ব্যস্ত। কে কী ভাবছে তা নিয়ে আমি মাথা ঘামাতেই চাই না,” বলছেন শ্রীকান্ত।
সব মিলিয়ে যা পরিস্থিতি, রিলিজের আগেই ‘চাঁদের পাহাড়’ টলিউডের হট টপিক।
বিভূতিভূষণের শঙ্করকে কেমন লাগল দর্শকের, ছবিটা গেম চেঞ্জার হতে পারল কি পারল না, তা জানতে বাকি মাত্র চোদ্দো দিন।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.