চায়ের দোকানে ঢুকতে গিয়ে পায়ে প্লাস্টিকের প্যাকেটটা ঠেকতে চমকে গিয়েছিলেন দিনমজুর যুবকটি। মোড়ক খুলতেই সাত সকালে চমকে যান তিনি। ভিতরে ১০০, ৫০০ ও ১০০০ টাকার অনেকগুলো নোট। গুনে দেখলেন ২৭ হাজার টাকা!
মঙ্গলবার কাশীপুর রাজবাড়ি মোড়ে দিনমজুর যুবক ভুবন বাউরির হাতে টাকার প্যাকেট দেখে ততক্ষণে তাঁকে ঘিরে ধরেন অন্য দিন মজুররা। তাঁদের কেউ কেউ ওই টাকার ভাগ দাবি করেন। কেউ বা তার আর্থিক দুরাবস্থার কথা মনে করিয়ে দিয়ে পরামর্শ দিয়েছিলেন, টাকাটা নিজের কাছে রেখে দেওয়ার। কিন্তু রামবনি গ্রামের দুই ছেলে-মেয়ে ও স্ত্রীর ভরণপোষনে জেরবার ভুবন তাঁদের কথা শোনেননি। জেদ ধরেছিলেন যাঁর টাকা, তাঁকেই তিনি ফেরত দেবেন। টাকা উদ্ধারের কথা পরিচিতজনদের জানিয়ে ওই টাকা মালিকের হদিশ করার চেষ্টা করেন তিনি। লোকমুখে দিনমজুরের টাকা উদ্ধারের খবর এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। খবর পান ওই টাকার মালিক কাশীপুর ব্লকের লিয়া গ্রামের মিহির মাহাতো। তিনি নাতনির বিয়ের গয়না কেনার বকেয়া টাকা দিতে কাশীপুরে মঙ্গলবার এসেছিলেন। রাস্তায় টাকার বান্ডিলটা খোয়া গিয়েছিলে। টাকার খবর শুনে তিনি তো আনন্দে আত্মহারা। বিকেলেই তিনি ভুবনের সঙ্গে যোগাযোগ করে টাকা ফেরত নিয়ে যান। খুশি হয়ে মিষ্টি খাওয়ার জন্য ভুবনকে তিনি বান্ডিল থেকে ১০০০ টাকা তুলে দেন।
বুধবার ভুবনকে পাওয়া গেল স্থানীয় একটি ধান-গুদামে। লরিতে তিনি ধানের বস্তা তুলছিলেন। কাজের ফাঁকে বলেন, “কাজে বের না হলে সংসার চলে না। |
কাজে যাওয়ার আগে চায়ের দোকানে চা খেতে ঢুকতে গিয়ে ওই বান্ডিলটা দেখতে পাই। অত টাকা দেখে কিন্তু মাথা ঘুরে যাইনি। সংসারে অনটন থাকলেও ওই টাকা যাঁর তাঁকে ফেরত দেব বলে ঠিক করি। অন্যরা অনেক পরামর্শ দিলেও তাতে কান দিইনি।” তিনি জানান, বাড়িতে ফিরে গিয়ে তিনি স্ত্রী সবুরা, ষষ্ঠ শ্রেণির মেয়ে সুমিতাকে টাকা পাওয়ার খবরটা দিয়েছিলেন। তারাও বলেছিলেন, ওই টাকা ফেরত দেওয়াই উচিত।
রাজবাড়ি মোড়ের কাছে পানের দোকান কাজল মোদকের। তিনি বলেন, “মঙ্গলবার সকালে এক ব্যক্তি এসে জানান, তাঁর নাতনির গয়নার টাকা হারিয়ে গিয়েছে। কেউ পেলে তাঁকে জানাতে বলে গিয়েছিলেন। ভুবনের মুখে টাকার খবর পেয়ে ওই ব্যক্তিকে খবরটা দিয়েছিলাম।” প্রান্তিক চাষি মিহির মাহাতোর নাতনির সামনেই বিয়ে। তিনি জানান, কাশীপুরে একটি গয়নার দোকান থেকে তিনি কিছু গয়না কিনেছিলেন। প্রায় ২৭ হাজার টাকা দোকানে বাকি ছিল। সেই টাকা মিটিয়ে দিতে বকেয়া টাকা নিয়ে তিনি মঙ্গলবার সকালে কাশীপুরে এসেছিলেন। তাঁর কথায়, “বাস থেকে নেমে একটি দোকানে চা খেয়ে বাইরে বের হতেই দেখি টাকার বান্ডিলটা নেই। ভিড়ে ঠাসা বাসেই টাকাটা পড়ে গিয়েছে মনে করে বাড়ি ফিরে যাই। ফেরার আগে রাজবাড়ি মোড়ের অনেককে টাকাটা কেউ পেলে খবর দেওয়ার জন্য বলেছিলাম। কিন্তু ফিরে পাব আশা করিনি।” মিহিরবাবুর ভাইপো বাবলু মাহাতোর কথায়, “সামান্য জমিতে কাকার চাষাবাদ রয়েছে। গরু-ছাগল বিক্রি করে ওই টাকাটা জোগাড় করেছিলেন। টাকাটা হারিয়ে যাওয়ার পরে মুষড়ে পড়েছিলেন তিনি।”
টাকা পেয়ে কেমন লাগছে? মিহিরবাবু বলেন, “টাকার বান্ডিলটা ভুবনবাবুর হাতে দেখে এত খুশি হয়েছিলাম, বলে বোঝাতে পারব না। শুনলাম তিনি দিনমজুরি করেন। খুব অল্প রোজগার। তবু তাঁর সততা দেখে আমি মুগ্ধ।” কাজে ফেরত যাওয়ার আগে ভুবন বলেন, “রোজ কাজ পাই না। কাজ পেলে দেড়শো-দু’শো টাকা রোজগার। কিন্তু ওই টাকা নিলে ধর্মে সইত না। তা ছাড়া টাকাটা একজন গরিব মানুষকে ফেরত দিয়েছি বলে মনটা আরও ভাল লাগছে।” কাশীপুর পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি সৌমেন বেলথরিয়া বলেন, “একজন দিনমজুর হয়ে যে সততার নজির ভুবনবাবু রাখলেন, তাতে আমরা মুগ্ধ। তাঁর এই কাজ যাতে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে, তাই আগামী যুব উৎসবে আমরা তাঁকে সম্মানিত করব। |