|
|
|
|
তিন দশক ধরে ঝাড়গ্রাম পুরসভায় থেকেও গণ্ডগ্রাম |
ঝোরাতে তেষ্টা মেটায় তালডাংরা |
কিংশুক গুপ্ত • ঝাড়গ্রাম |
পরিস্রুত পানীয় জল মেলে না। অগত্যা বাসিন্দারা ঝোরার জল পান করেন। এখনও বিদ্যুৎ সংযোগ আসেনি। চলার মেঠো পথ শেষ হয়ে গিয়েছে খালের পাড়ে। বর্ষায় খালে জল বাড়লে, তখন ঘুরপথে যেতে কাল-ঘাম ছোটে। এটা কোনও গ্রামের কথা নয়। ‘নেই রাজ্যে’র এই এলাকা ঝাড়গ্রাম শহরে। ৩১ বছরের পুরসভায় এখনও প্রান্তবাসী ৫ নম্বর ওয়ার্ডের তালডাংরা পাড়া।
২৫টি আদিবাসী পরিবার। বাসিন্দা ১২৫। সামান্য এক-দু’বিঘে জমিতে চাষাবাদের পাশাপাশি কমবেশি সকলেই দিনমজুরি করেন। বংশ পরম্পরায় তালডাংরায় বসবাস করে আসা আদিবাসী পরিবারগুলির সিংহভাগই বিপিএল তালিকাভুক্ত। কিন্তু গত তিন দশকে পুর-পরিষেবার উচ্ছিষ্ট অংশও জোটেনি এলাকাবাসীর কপালে। পুরসভার একটি পাতকুয়ো রয়েছে তালডাংরায়। কিন্তু কুয়োর জল ব্যবহারের অযোগ্য। খাতায় কলমে ‘সচল’ সরকারি টিউবওয়েলও রয়েছে একটি। বাস্তবে গত ছ’বছর ধরে টিউবওয়েলটি অকেজো। স্থানীয় আদিবাসী বধূ শীতলমণি মুর্মু, সরস্বতী হাঁসদা, দুলি টুডুরা স্থানীয় নহর খালের কাছে কিয়াঝোরার জল ছেঁচে স্টিলের বাটিতে করে কলসিতে ভরছিলেন। তাঁদের কথায়, প্রাকৃতিক কিয়াঝোরার জল কখনও শুকোয় না। কিন্তু বর্ষাকালে খালের জল বেড়ে গেলে তখন ঝোরাটি ঘোলা জলে ডুবে যায়। বাধ্য হয়ে ওই জলই ছেঁকে-ফুটিয়ে খেতে হয়। |
|
ঝোরার জল ছেঁচে ভরছে কলসি। |
শহরের এই প্রান্ত-এলাকাটি ঝাড়গ্রাম ব্লকের রাধানগর পঞ্চায়েত এবং বিনপুর-১ ব্লকের দহিজুড়ি পঞ্চায়েত এলাকার লাগোয়া। এলাকাবাসীর বক্তব্য, তালডাংরার পুবদিকে নহর খাল পেরোলেই ৫ নম্বর রাজ্য সড়ক। খাল পেরিয়ে রাধানগর পঞ্চায়েতের বেতকুন্দরি হয়ে রাজ্য সড়কের ওই পথে কম সময়ে মধ্যে ঝাড়গ্রাম শহরের বাজার, রেল স্টেশন, ব্যাঙ্ক, জেলা হাসপাতালে পৌঁছনো যায়। তালডাংরার ছেলে-মেয়েরা স্থানীয় বেতকুন্দরি প্রাথমিক বিদ্যালয় কিংবা বিনপুরের দহিজুড়ি হাইস্কুলে পড়াশুনা করে। খাল পেরোলেই অল্প সময়ের মধ্যে ওই দু’টি স্কুলে পৌঁছনো যায়। বাসিন্দাদের দীর্ঘ দিনের দাবি, তালডাংরার কাছে নহর খালের উপর একটি কালভার্ট বা কজওয়ে তৈরি করে দেওয়া হোক। কিন্তু ৩১ বছরেও সেই দাবি পূরণ হয়নি। তালডাংরার বাসিন্দা বেতকুন্দরি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র বিজয় হেমব্রম, দহিজুড়ি হাইস্কুলের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী পারুল সরেন, ষষ্ঠ শ্রেণির চম্পা মুর্মু, সপ্তম শ্রেণির রানি হাঁসদার কথায়, “বর্ষাকালে কিংবা বেশি বৃষ্টি হলে খালে জল বেড়ে যায়। তখন স্কুলে কামাই হয়। ওই সময় পরীক্ষা থাকলে খুবই সমস্যা হয়।” স্থানীয় বাসিন্দা দাসমত হেমব্রম, গোরাচাঁদ হাঁসদা, গুরুচরণ হাঁসদা, ধনঞ্জয় মাণ্ডিদের বক্তব্য, “আমরাও এ ভাবে স্কুলে গিয়েছি। এখন আমাদের সন্তানেরাও খাল পেরিয়ে স্কুলে যাচ্ছে। বহুবার পুর-কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। কোনও ফল হয়নি।”
বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকায় সন্ধে হলেই অন্ধকারে ডুবে যায় তালডাংরা। পথবাতি বহু দূর। এবার পুরভোটের আগে এলাকায় বিদ্যুতের খুঁটি পুতে তার লাগানো হয়েছে। তবে এখনও সংযোগ দেওয়া হয়নি। অন্ধকারে পথ চলতে গিয়ে মাঝে-মধ্যেই সর্পাঘাতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। বাসিন্দাদের বক্তব্য, রাত বিরেতে কেউ অসুস্থ হলে খুবই সমস্যা হয়। পুর এলাকার মধ্যে দিয়ে উপযুক্ত রাস্তার অভাবে এলাকায় অ্যাম্বুল্যান্স ঢোকার জো নেই। তখন সেই নহর খাল পেরিয়ে অসুস্থদের খাটিয়ায় ঝুলিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়। কখনও হাসপাতাল নিয়ে যাওয়ার পথেই মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে। যেমন, দু’বছর আগে এক সন্ধ্যায় তালডাংরার সাত বছরের বালিকা নীলিমা হেমব্রমকে সাপে কামড়েছিল। দেরিতে হাসপাতালে পৌঁছনোয় নীলিমাকে বাঁচাতে পারেননি চিকিৎসকেরা। নীলিমার বাবা পেশায় লরির খালাসি দশরথ হেমব্রম চোখের জল মুছে বলেন, “২০১১ সালে অন্ধকার রাস্তায় হাঁটার সময় নীলিমাকে সাপে কামড়েছিল। খাল পেরিয়ে ঝাড়গ্রাম হাসপাতাল পৌঁছতে অনেকটা দেরি হয়ে যাওয়ায় মেয়েকে চিরতরে হারিয়েছি।” |
|
এ ভাবেই খাল পেরিয়ে নিত্য যাতায়াত। |
এলাকার প্রবীণ বাসিন্দা লাছো হেমব্রম, ঠাকুরমণি মুর্মু, কাজলমণি টুডু-দের কথায়, “আগে আমরা পঞ্চায়েত এলাকার বাসিন্দা ছিলাম। ১৯৮২ সালে ঝাড়গ্রাম পুরসভা গঠিত হয়। তখন থেকে আমরা শহরবাসী। অথচ ৩১ বছরেও আমাদের এলাকার হাল ফিরল না। আমাদের এলাকাটি দেখলে প্রত্যন্ত গ্রামের বাসিন্দারাও লজ্জা পাবেন।” বাসিন্দারা জানালেন, প্রত্যেক বার ভোটের আগে রাজনৈতিক দলগুলি নানা প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু কেউই কিছু করে না।
এবার ৫ নম্বর ওয়ার্ড থেকে কাউন্সিলর পদে নির্বাচিত হয়েছেন তৃণমূলের ছবি মজুমদার। ছবিদেবীর কথায়, “তালডাংরার বাসিন্দারা চরম বঞ্চনার শিকার। সেই কারণে ওই এলাকা থেকেই আমি ভোটের প্রচার শুরু করেছিলাম। অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে ওই এলাকার উন্নয়নের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করব।”
কেন তালডাংরার এই অবস্থা? বিদায়ী পুরপ্রধান সিপিএমের প্রদীপ সরকারের বক্তব্য, “পুরএলাকার মধ্যে দিয়ে তালডাংরার যাওয়ার জন্য আড়াই কিমি রাস্তা তৈরি করা প্রয়োজন। পর্যাপ্ত অর্থের অভাবে সেটা করা সম্ভব হয়নি। তালডাংরা থেকে নহর খালের অপর প্রান্তে বেতকুন্দরি এলাকাটি ঝাড়গ্রাম ব্লকের রাধানগর পঞ্চায়েত এলাকার মধ্যে পড়ে। ফলে ওখানে কজওয়ে বা কালভার্ট তৈরির ক্ষেত্রে সমস্যা রয়েছে। তবে ঝাড়গ্রামের সাংসদ কোটার টাকায় এলাকায় বৈদ্যুতীকরণের কাজ হয়েছে। বাসিন্দারা কেউ আবেদন করেননি বলে সংযোগ পাননি।”
ঝাড়গ্রামের ভাবী পুরপ্রধান দুর্গেশ মল্লদেব বলেন, “তালডাংরার পরিস্থিতি অত্যন্ত লজ্জাজনক। এর দায় বামেরা এড়াতে পারে না। আমরা ওই এলাকার সর্বাঙ্গীণ উন্নয়নে উদ্যোগী হব।”
|
ছবি তুলেছেন দেবরাজ ঘোষ। |
|
|
|
|
|