নিম্ন আদালতে সাজা হয়েছিল। উচ্চ আদালতে অব্যাহতি মিলল। কিন্তু তার মধ্যে সব মিলিয়ে তেরোটা বছর জেলে কাটানো হয়ে গিয়েছে। স্রেফ বিচার পেতে দেরির কারণে জীবন যে কতটা ধ্বস্ত হয়ে যেতে পারে, মুনমুন বসুর চেয়ে ভাল কেউ জানে না এই মুহূর্তে।
“ফিরিয়ে দাও আমার বারোটা বছর”, ‘সবার উপরে’ ছবির এই সংলাপ এক সময় মানুষের মুখে মুখে ঘুরত। মুনমুন তাঁর জীবনের মোট তেরোটা বছর হারিয়ে ফেলেছেন। সিনেমার গল্পে আপিল মামলা দায়ের হতেই কেটে গিয়েছিল একটা যুগ। কিন্তু মুনমুন প্রথমে বিচারাধীন অবস্থায় তিন বছর জেলে ছিলেন। নিম্ন আদালতে সাজা হওয়ার পরই আপিল মামলা দায়ের করা হয়েছিল। কিন্তু বিচার পেতে লেগে গেল আরও দশ-দশটা বছর।
কুণাল বসু হত্যা মামলায় নিম্ন আদালতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা হয়েছিল নান্টু রায় এবং কুণালের স্ত্রী অপরাজিতা ওরফে মুনমুন বসুর। বুধবার কলকাতা হাইকোর্টে বিচারপতি অসীম রায় ও বিচারপতি সুবল বৈদ্যের ডিভিশন বেঞ্চ মুনমুনকে বেকসুর খালাস করে দিয়েছে। নান্টুর শাস্তি বহাল রয়েছে।
মুনমুনের আইনজীবী জয়ন্তনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় তাঁর সওয়ালে বলেন, একমাত্র ছেলের সঙ্গে নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ের বিয়ে কুণালের পরিবার প্রথম থেকেই মেনে নিতে পারেনি। তাই এই মৃত্যুর সঙ্গে বাড়ির লোকেরা প্রথম থেকেই মুনমুনকে অভিযুক্ত করে এসেছেন। কিন্তু এক জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়ার আগে যে সব প্রমাণ খতিয়ে দেখা প্রয়োজন, সে সব ছাড়াই নিম্ন আদালত মুনমুনকে দোষী সাব্যস্ত করেছে। |
শুনানি শেষে ডিভিশন বেঞ্চ এ দিন তার রায়ে পরিষ্কার বলল কুণালের মৃত্যুতে মুনমুনের হাত ছিল, এমন কোনও প্রামাণ্য তথ্য নেই। বরং মুনমুনের দুই ছেলের কথা উল্লেখ করে হাইকোর্টের বক্তব্য, বাবাকে হারানোর পরে দু’টি শিশুকে তাদের মায়ের সান্নিধ্য থেকেও বঞ্চিত করা হয়েছে।
তেরো বছর আগে মুনমুুন যখন গ্রেফতার হন, তখন তাঁর দুই শিশুপুত্রের বয়স ছিল যথাক্রমে পাঁচ ও চার। ২০০০ সালের ২৬ মে নিখোঁজ হয়ে যান কুণাল। ওই দিনই তিলজলা থানা এলাকা থেকে এক যুবকের ক্ষতবিক্ষত দেহ উদ্ধার করে পুলিশ। পরের দিন হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়। তখনও যুবকের পরিচয় জানা যায়নি। দিন কয়েক পরে কুণালের বন্ধু নান্টু রায় তিলজলা থানায় গিয়ে কুণাল সম্পর্কে খোঁজখবর নিচ্ছিলেন। কথাবার্তা শুনে সন্দেহ হওয়ায় পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে। নান্টুর বয়ানের ভিত্তিতেই ৪ জুন মুনমুনও গ্রেফতার হন। এর পর ২০০৩ সালে আলিপুর আদালত মুনমুন ও নান্টুকে দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা দেয়। ওই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে ওই বছরেই হাইকোর্টে আবেদন করেন মুনমুনের মা ও দাদা। দশ বছর পার করে আদালতে সেই মামলারই রায় বেরোল এ দিন।
কোর্টের রেকর্ড বলছে, আপিল করার আট থেকে দশ বছর পরে মামলার নিষ্পত্তি হয়ে খালাস পাওয়ার বহু নজির রয়েছে। পুরুলিয়ার মালতী বাগদির ঘটনা তার চেয়েও করুণ। প্রতিবেশী একটি ছেলেকে হত্যার দায়ে মালতীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছিল। তিনি হাইকোর্টে আপিল করেন। মামলাটি বিচারের জন্য ওঠে প্রায় ২৫ বছর পর। তখন দেখা যায়, মৃতদেহের ময়নাতদন্ত পর্যন্ত করা হয়নি। ২৫ বছর জেল খাটার পরে মালতী বেকসুর খালাস পান।
কেন এত দেরি হয় বিচার পেতে? এতটাই দেরি হয় যে, বিচার না পাওয়ারই সামিল হয়ে যায়? রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান তথা সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “আদালতের সংখ্যা না বাড়ালে, বিচারপতি এবং বিচারকের সংখ্যা না বাড়ালে এই সমস্যা থাকবেই।” বিচারপতির অভাবকে দায়ী করছেন ইলাহাবাদ হাইকোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি চিত্ততোষ মুখোপাধ্যায়ও। সুরাহার জন্য তাঁর মত, “যে সব বন্দি অন্তর্বর্তী জামিন পাননি, মামলায় তাঁদের শুনানি আগে হওয়া প্রয়োজন। মানবাধিকার সংগঠনগুলো এ ব্যাপারে ইতিবাচক ভূমিকা নিতে পারে। হাইকোর্টের কাজের সময় কিছুটা বাড়াতে পারলেও ভাল হয়।”
কলকাতা হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি ভগবতীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় এ ধরনের ক্ষেত্রে সরাসরি ক্ষতিপূরণের দাবি তুলছেন। তিনি বলেন, “বিচারে দেরির কারণে যে সব নির্দোষকে জেল খাটতে হয়, তাঁদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত রাষ্ট্রের। অনেক রাষ্ট্রে এ রকম আইন আছে।” হাইকোর্টের আইনজীবী অরুণাভ ঘোষও বলেন, “বিচারপতি কম থাকায় আপিল মামলা দীর্ঘ দিন পড়ে থাকে। এই দেরির জন্য অবশ্যই ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত সরকারের।”
মুনমুন কি ক্ষতিপূরণ চাইবেন? মুনমুনের উত্তর, “যা হারিয়েছি তা তো আর ফিরে পাব না! আমি আমার ছেলেদের ফিরে পেলেই মনে করব অনেক কিছু পেয়েছি। আমার অন্য কোনও ক্ষতিপূরণের প্রয়োজন নেই।”
মায়ের কাছে যেতে চাও না? প্রশ্ন করা হয়েছিল মুনমুনের ছেলে অভ্রনীলকে। ১৭ বছরের কিশোরের জবাব, “আমার ঠাকুমা আছেন, কাকা আছেন। মা-কে আমি চিনি না।” |