ছাত্র-ছাত্রীর অভাবে যখন জেলার বেশির ভাগ প্রাথমিক বিদ্যালয় সঙ্কটে, তখন রাজ্যের শিশুমিত্র পুরস্কার পেল কালনার আটঘড়িয়া-সিমলন পঞ্চায়েতের সূর্যপুর গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়। সম্প্রতি কলকাতার টাউন হলে একটি অনুষ্ঠানে এই পুরস্কার তুলে দেওয়া হয় ওই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের হাতে।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদ সূত্রে জানা গিয়েছে, শিশুমিত্র পুরস্কারটি দেওয়া হয়েছে রাজ্যের সর্বশিক্ষা মিশন এবং ইউনিসেফের উদ্যোগে। প্রাথমিক ভাবে জেলার ৫৯টি চক্র থেকে তিনটি করে বিদ্যালয়কে বাছা হয়েছিল। এর পর জেলা স্তর থেকে পরিদর্শক দল এসে প্রতিটি চক্র থেকে একটি করে স্কুল বেছে নেয়। সেই তালিকা থেকে চলতি বছরের ২৯ থেকে ৩১ অক্টোবর রাজ্য স্তরের প্রতিনিধি দল জেলায় দু’টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও একটি উচ্চ বিদ্যালয়কে বেছে নেয় পুরস্কারের জন্য। সূর্যপুরের পাশাপাশি কেতুগ্রাম পশ্চিম চক্রের ৯৯ নম্বর কান্টারি পূর্বপাড়া অবৈতনিক প্রাথমিক স্কুলও শিশুমিত্র পুরস্কার পায়। উচ্চ বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে এই পুরস্কার পেয়েছে গুসকরা-১ চক্রের এরাল অঞ্চল উচ্চ বিদ্যালয়। |
কী ভাবে এল সাফল্য?
১৯৫৬ সালে তৈরি হওয়া সূর্যপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় সূত্রে জানা গিয়েছে, নির্দিষ্ট পরিকল্পনার মাধ্যমেই লক্ষ্যপূরণ করেছেন তারা। এ বছর পুজোর সময় ছাত্রছাত্রীদের স্কুলের পোশাক কেনার জন্য মাথা পিছু ৪০০ টাকা বরাদ্দ ছিল। বিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবকদের জানানো হয়, নগদ অর্থ না দিয়ে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষই ছাত্রছাত্রীদের পোশাক তৈরি করে দেবে। সেই অনুযায়ী তৈরি হয় পোশাক। পোশাকের সঙ্গে দেওয়া হয় জুতো, ব্যাগ, টাই। একই বরাদ্দ অর্থে অতিরিক্ত জিনিস দেওয়া হল কী ভাবে? বিদ্যালয় সূত্রে জানা গিয়েছে, একই সঙ্গে অনেক পরিমাণ পোশাক কেনায় খরচ কম পড়ে। উদ্বৃত্ত অর্থ থেকে কেনা হয় বাকি সামগ্রী। জেলার অনেক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যেখানে জলের ব্যবস্থাই নেই, সেখানে এই বিদ্যালয়ে পঞ্চায়েত সমিতির উদ্যোগে বসানো হয়েছে সাব মার্সিবল পাম্প।
কী ভাবে সাজানো হয়েছে বিদ্যালয় চত্বর? পড়াশোনার পরিবেশই বা কী রকম?
বিদ্যালয় চত্বরে ফুল ও সব্জির সাজানো বাগান। প্রতিটি গাছের গায়ে লেখা রয়েছে নাম। বাঁধানো রয়েছে প্রতিটি গাছের গোড়া। রয়েছে দোলনা ও ভাল নিকাশি ব্যবস্থা। প্রতিটি ক্লাসঘরে টাঙানো রয়েছে রঙিন বোর্ড। দেওয়ালে লেখা রয়েছে ‘শিশু সংসদ বলছে শোনো, আমাদের ছোট্ট ভেবো না যেন’-সহ নানা স্লোগান। প্রতিটি ছাত্রছাত্রীই টাই-সহ নির্দিষ্ট পোশাক পড়ে বিদ্যালয়ে আসে। শিক্ষক-শিক্ষিকারা ক্লাসে ঢুকলে ‘সুপ্রভাত’ বলে। বিদ্যালয়ের শিক্ষক তন্ময় পাল, সুব্রত শীল বলেন, ‘‘শিশুরা সাধারণত কালো বোর্ড পছন্দ করে না। তাই রঙিন বোর্ডের ব্যবস্থা করা হয়েছে।” বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকের সংখ্যা, কোন সম্প্রদায়ের কত ছাত্রছাত্রী, সরকারি অনুদানের হিসেব- সবই দেওয়া রয়েছে বিদ্যালয় চত্বরে।
স্কুল চত্বরের মধ্যে রয়েছে বর্জ্য পদার্থ ফেলার দু’টি জায়গা। শিক্ষক-শিক্ষিকারা জানিয়েছেন, বর্জ্য ফেলার সময়েই ছাত্রছাত্রীরা জেনে যায় কোন দ্রব্য পচনশীল আর কোন দ্রব্য পচনশীল নয়। পচনশীল বর্জ্য থেকে জৈব সার তৈরির ব্যবস্থাও রয়েছে এই বিদ্যালয়ে। |
স্কুলের বাগানে নাম লেখা ওষধি গাছ। |
মিড-ডে মিলের রান্নাঘরে রয়েছে ধোঁয়াবিহীন চুল্লি ও আগুন নেভানোর ব্যবস্থা। রান্নাঘর লাগোয়া জমিতে রয়েছে জলের ট্যাঙ্ক। এর মধ্যে জমা হওয়া জল বাসন মাজার কাজে লাগে। তার পর নালার মাধ্যমে জল পাঠানো হয় মাটির নীচে। ছাত্রছাত্রীদের মুখ ধোওয়ার জন্যও বেশ কয়েকটি ট্যাপ কল রয়েছে। ছাত্র ও ছাত্রীদের জন্য রয়েছে আলাদা আলাদা শৌচাগার।
সূর্যপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় যখন পেরেছে, তখন কোথায় পিছিয়ে রয়েছে জেলার বাকি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলি?
সূর্যপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কাছাকাছি রয়েছে সলগড়িয়া, বৃদ্ধপাড়া, সারগড়িয়া গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়। বরাদ্দ অনুদান ও প্রকল্পের পরিমাণ এক হলেও এই বিদ্যালয়গুলি চলে গতানুগতিক পদ্ধতিতে। আলাদা করে কোনও সচেতনতামূলক প্রচার করা হয় না। জেলার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের কথায়, “আসলে পার্থক্য গড়ে দিয়েছে সূর্যপুর গ্রামের সাধারণ মানুষ। ওরা বিদ্যালয়ের বিষয়ে যথেষ্ট আন্তরিক।”
সূর্যপুর প্রাথমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক পিন্টু দাম বলেন, “শিক্ষক ও গ্রামবাসীদের আন্তরিকতার ফলেই এই কাজ সম্ভব হয়েছে।” স্থানীয় আটঘড়িয়া-সিমলন পঞ্চায়েতের উপপ্রধান জয়দেব প্রামাণিকের কথায়, “ওই স্কুলের শিক্ষকেরা অনেক রাত পর্যন্ত বিদ্যালয়ে থেকে কাজ করেন। ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার মানও যথেষ্ট উন্নত।” স্থানীয় বাসিন্দা কালীপদ ঘোষ, বরকত কাজিদের কথায়, “এই স্কুল গোটা গ্রামেরই গর্ব।” জেলা প্রাথমিক বিদ্যালয় সংসদের চেয়ারম্যান দেবাশিস নাগ বলেন, “শিশুমিত্র পুরস্কার পাওয়া জেলার দু’টি প্রাথমিক স্কুলেরই পরিকাঠামো উন্নত। ওরা আমাদের জন্য মডেল।” |