একটা লম্বা লাফ!
শনিবার মধ্যরাতে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে লালগ্রহের দিকে রওনা দিল মঙ্গলযান। আর সঙ্গে সঙ্গেই মহাকাশ গবেষণায় চিন-জাপানকে টপকে গেল ভারত। জানাচ্ছে ইসরো-ই।
দাবির সপক্ষে যুক্তিও দিয়েছেন ইসরোর মহাকাশ বিজ্ঞানীরা। তাঁরা বলছেন, ২০১১ সালে চিনের মঙ্গলগামী মহাকাশযান পৃথিবীর কক্ষপথের বাইরে যাওয়ার আগেই ভেঙে পড়েছিল। ১৯৯৮ সালে জাপানের মঙ্গল-যানও এক ধাক্কায় পৃথিবীর বাইরে যেতে পারেনি। সে দিক থেকে শনিবার রাতে ইসরোর সাফল্য ভারতকে মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রে এশিয়া তো বটেই, বিশ্বের মধ্যেও প্রথম সারিতে বসাল। কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থা, পজিশন্যাল অ্যাস্ট্রোনমি সেন্টারের অধিকর্তা সঞ্জীব সেন বলেন, “শনিবার রাতের সাফল্য ভারতীয় প্রযুক্তির উৎকর্ষকেই প্রমাণ করেছে।”
গত ৫ নভেম্বর অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীহরিকোটার সতীশ ধবন মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র থেকে উৎক্ষেপণের পর পৃথিবীর চার পাশে পাক খাচ্ছিল মঙ্গলযান। শনিবার গভীর রাতে পৃথিবীর অভিকর্ষ বলের টান কাটিয়ে মঙ্গলের উদ্দেশে রওনা দিয়েছে সে। রাত ১২টা ৪৯ মিনিটে মহাকাশযানের ইঞ্জিন চালু করেন বিজ্ঞানীরা। ইসরো জানাচ্ছে, ২৩ মিনিটের মধ্যে মঙ্গলের যাত্রাপথে (ট্রান্স মার্সিয়ান অরবিট) স্থাপন করা হয় মঙ্গলযানকে। পৃথিবীর টান কাটিয়ে বেরোনোর সময় মঙ্গলযানের গতিবেগ ছিল, সেকেন্ডে ১২ কিলোমিটারের কাছাকাছি। এর পর প্রায় ৩০০ দিনের যাত্রাপথ শেষে আগামী বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর মঙ্গলের কক্ষপথে
পৌঁছবে সে। |
বেঙ্গালুরুর জওহরলাল নেহরু তারামণ্ডলের অধিকর্তা ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী বি এস শৈলজা বলছেন, “মঙ্গল অভিযানের ক্ষেত্রে শতকরা ৫০ ভাগ ব্যর্থ হয়। সে ক্ষেত্রে ইসরো প্রথম চেষ্টাতেই এত দূর এগিয়েছে। এটা দারুণ ব্যাপার।” আমদাবাদের কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থা, ফিজিক্যাল রিসার্চ ল্যাবরেটরির মহাকাশবিজ্ঞানের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক উমেশচন্দ্র জোশী বলছেন, “পৃথিবীর কক্ষপথ ছেড়ে বেরোনোটা খুব কঠিন ছিল। এর আগে চিন চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। এই কাজে ইসরো সফল হওয়ায় প্রযুক্তিগত দিক থেকেও কৃতিত্ব অর্জন করেছেন বিজ্ঞানীরা।”
আরও একটা দিক দিয়ে এই ঘটনাকে ভারতীয় মহাকাশ গবেষণার সাফল্য বলে দেখাতে চান বিজ্ঞানীরা। তাঁরা বলেন, চিন বা জাপানের অভিযানের অনেকটাই নির্ভর করেছিল উন্নত দেশগুলির প্রযুক্তির উপরে। মহাকাশে যোগাযোগ ব্যবস্থা-সহ কিছু ক্ষেত্রে নাসার সাহায্য নিলেও মহাকাশযান ও তার যন্ত্রাংশ তৈরি করেছে ইসরো নিজেরাই এবং অনেকটাই কম খরচে। তবে নিজেদের খরচে, নিজেদের প্রযুক্তিতে মহাকাশযান তৈরি হওয়ায় তার শক্তি যে মার্কিন মহাকাশযানের থেকে কম, তা কিন্তু অস্বীকার করছেন না ইসরোর মহাকাশ বিজ্ঞানীরা। নাসা আমেরিকার কেপ ক্যানাভেরাল থেকে মঙ্গলগামী নতুন কৃত্রিম উপগ্রহ মাভেন-কে উৎক্ষেপণ করেছে গত ১৮ নভেম্বর। মাভেন ইতিমধ্যেই পৃথিবীর কক্ষপথ ছেড়ে পৌঁছে গিয়েছে মহাশূন্যে। কারণ, মার্কিন রকেট অ্যাটলাস-৫ ভারতীয় রকেটের তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী। তাই ভারতীয় মঙ্গলযানের এতটা সময় লেগে গেল পৃথিবীর কক্ষপথ ছাড়তে।
ইসরোর এক বিজ্ঞানী জানাচ্ছেন, রকেটের শক্তি তুলনামূলক ভাবে কম থাকায় পৃথিবীর চার পাশে পাক খাইয়ে খাইয়ে মঙ্গলযানের গতি বাড়াতে হয়েছে। অলিম্পিক গেমসে হ্যামার থ্রোয়ের সময় যেমন করে খেলোয়াড়েরা পাক খেয়ে ছুড়ে মারেন, ঠিক তেমন।
ওই মহাকাশ বিজ্ঞানী জানান, যাত্রাপথের একটা বড় বাধা উতরে গিয়েছে মঙ্গলযান। তবে এটাই যে শেষ চ্যালেঞ্জ নয়, ইসরো সে ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছে। ইসরো সূত্রে বলা হয়েছে, ৩০০ দিনের যাত্রাপথ অতিক্রম করে মঙ্গলের কক্ষপথে পৌঁছবে মহাকাশযান। এই যাত্রাপথে আরও বাধার মুখে পড়তে হতে পারে তাকে।
যাত্রাপথে আর কী কী ধরনের বাধার অপেক্ষায় মঙ্গলযান? সঞ্জীববাবু জানান, মহাকাশের এই যাত্রাপথে সৌরঝড় বা তড়িদাহত কণার স্রোতের সামনে পড়তে পারে মঙ্গলযান। নাসার সৌর-পদার্থবিদ্যা বিভাগের বিজ্ঞানী মধুলিকা গুহঠাকুরতা বলছেন, “সূর্য থেকে ছড়িয়ে পড়া তড়িদাহত কণা মহাকাশযানের বৈদ্যুতিন যন্ত্রাংশের ক্ষতি করতে পারে। এমন ঘটনার উদাহরণ আগেও রয়েছে।”
তবে ইসরো এ বিষয়ে অনেকটাই নিশ্চিন্ত। তারা জানিয়েছে, তেজস্ক্রিয়তা সহ্য করার মতো চাদর মঙ্গলযানের গায়ে চাপানো রয়েছে। ফলে ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা তেমন নেই। পৃথিবীকে ঘিরেই রয়েছে ‘ভ্যান আলেন রেডিয়েশন বেল্ট’ নামে একটি তেজস্ক্রিয় কণার ফিতে। সে পথ ভাল ভাবেই পেরিয়েছে মঙ্গলযান, জানাচ্ছেন ইসরোর বিজ্ঞানীরা।
বরং মঙ্গলযানের শেষ পথটাকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন ইসরো কর্তারা। তাঁরা বলছেন, লাল গ্রহের কক্ষপথে ভারতীয় দূতকে স্থাপন করাটাই সব থেকে কঠিন কাজ। হিসেবের সামান্য ভুলচুকে গোটা অভিযানটাই ব্যর্থ হতে পারে। লাল গ্রহের মাটিতে আছড়ে পড়ে নষ্ট হয়ে যেতে পারে মঙ্গলযান। সংস্থার এক মুখপাত্র জানান, লাল গ্রহের কক্ষপথে প্রবেশের ঠিক আগে মহাকাশযানের মুখ ঘুরিয়ে ইঞ্জিন চালু করা হবে। এর ফলে তার গতি কমবে অনেকটাই। ফলে ঠিকঠাক ভাবে কক্ষপথে স্থাপন করা যাবে তাকে। |