মা-বাবা ইটভাটায় কাজ করেন। তাঁদের সঙ্গে হাত লাগায় ছোট্ট ছেলে কিংবা মেয়েটিও। সারাদিন বালি, কাদা, মাটি ঘাঁটার পর অচিরেই তারা হয়ে ওঠে শিশুশ্রমিক। শৈশব হারানোর যন্ত্রণা ঢাকতে অনেকেই অল্প বয়সে ডুব দেয় নেশায়। এই চেনা চিত্রে বদল আনতে এ বার উদ্যোগী হল কালনা ব্রিক ফিল্ড অ্যাসোসিয়েশন। ভাটা শ্রমিকদের ছোট ছেলেমেয়েদের প্রাথমিক শিক্ষা দিতে মহকুমার প্রতিটি ইটভাটাতে বিদ্যালয় খোলার উদ্যোগ নিয়েছে এই সংগঠন। রবিবার স্থানীয় কৃষ্ণদেবপুর, ধাত্রীগ্রাম ও শ্রীরামপুর এলাকায় এ রকম তিনটি বিদ্যালয়ের উদ্বোধন করলেন মন্ত্রী স্বপন দেবনাথ।
এ দিন কালনার কৃষ্ণদেবপুরের ইটভাটা বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেল বিদ্যালয়ের জন্য তৈরি করা হয়েছে দোতলা পাকা বাড়ি। বিদ্যালয়টির নাম দেওয়া হয়েছে কালনা মিশ্র সোস্যাল ওয়েলফেয়ার অর্গানাইজেশন শিশু বিদ্যালয়। ইটভাটার মালিক সুদীপ মিশ্র জানান, আপাতত এই বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ৫৩। প্রত্যেকেরই বয়স পাঁচ থেকে দশের মধ্যে। তাঁর দাবি, এ রাজ্যে এই উদ্যোগ প্রথম। ঠিক হয়েছে আপাতত সপ্তাহে ৬দিন ক্লাস হবে। প্রতি দিন ক্লাস হবে দিনে দু’বার করে। প্রথমে সকাল ১০টা থেকে ১২টা। তার পর বিকেল ৪টে থেকে ৬টা। একঘেয়েমি কাটাতে কখনও ক্লাস হবে ঘরে, কখনও বাইরে। শনিবার স্কুল বন্ধ থাকবে। প্রত্যেক পড়ুয়ার জন্য তৈরি করে দেওয়া হয়েছে স্কুলের নির্দিষ্ট পোশাক। |
ইটভাটা সংগঠন সূত্রে জানা গিয়েছে, এ রাজ্যে ইটভাটার সংখ্যা তিন হাজারেরও বেশি। এই ইটভাটায় পরোক্ষ ভাবে জড়িত প্রায় দেড় লক্ষ শিশু রয়েছে যারা শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত। কালনা ১ ও ২ ব্লকে মোট ২২টি ইটভাটা রয়েছে। এই ভাটাগুলিতে দক্ষ শ্রমিক হিসেবে বিহার ও ঝাড়খণ্ড থেকে মানুষ কাজ করতে আসেন। প্রতি বছর অক্টোবরে এই রাজ্যে এসে আবার মে মাস নাগাদ ফিরে যায় তারা। কারণ মে মাসের পরে বর্ষা নেমে যাওয়ার কারণে চার মাস বন্ধ থাকে ইটভাটার কাজ। ইটভাটা সংগঠনের সদস্যরা হিসেব করে জানিয়েছেন, কালনার ভাটাগুলিতে ভিন রাজ্যের শ্রমিকের সঙ্গে আসা শিশুর সংখ্যা প্রায় ১৯০০। এদের মধ্যে ৫ থেকে ১০ বছরের মধ্যে রয়েছে অন্তত ১০০০ শিশু। নিজের রাজ্যে ৪ মাস ও বাইরে ৮ মাস থাকার কারণে কোনও প্রথাগত বিদ্যালয়েই ভর্তি হতে পারে না তারা। ফলে মূলত হিন্দিভাষী এই শিশুদের সাধারণত অক্ষর জ্ঞানও থাকে না। তাই এই শিশুদের শিক্ষার অধিকার ফিরিয়ে দিতেই এই উদ্যোগ বলে জানিয়েছেন ইটভাটা সংগঠনের কর্তারা।
এ দিন কালনার ধাত্রীগ্রাম ও কৃষ্ণদেবপুরে ইটভাটা বিদ্যালয়ের উদ্বোধনে উপস্থিত ছিলেন বেঙ্গল ব্রিক অ্যান্ড ফিল্ড অ্যাসোসিয়েশনের কার্যকরী সমিতির সদস্য কমল হাওলাদার। তিনি বলেন, “কালনায় যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে সেটা যাতে রাজ্যের অন্যান্য জায়গাতেও নেওয়া যায় তার চেষ্টা করা হবে।”
|
এই বিদ্যালয়ের উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, আট মাসের এই বিদ্যালয়ে প্রাথমিক ভাবে শিশুদের ইংরেজি ও হিন্দি অক্ষর শিক্ষা দেওয়া হবে। তার পর শেখানো হবে নাম সই, অঙ্ক, ছবি আঁকার বিষয়। রামায়ণের মতো মহাকাব্য সর্ম্পকে গল্পের মাধমে ওয়াকিবহাল করা হবে। বিদ্যালয়ে যেতে আগ্রহ দেওয়ার জন্য প্রতি দিন ছাত্রছাত্রীদের দেওয়া হবে চকলেট ও বিস্কুট।
ইটভাটা মালিকদের এই উদ্যোগে খুশি রাজ্যের মন্ত্রী স্বপন দেবনাথ। তাঁর কথায়, “পড়াশোনা শিখলে ইটভাটা শ্রমিকের শিশুরা নতুন পৃথিবী পাবে। এই ধরনের স্কুলে যাতে মিড ডে মিল চালু করা যায় তার জন্য কালনা-১ ও পূর্বস্থলী-১ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতিকে উদ্যোগ নিতে বলেছি।” তাঁর দাবি, এই বিদ্যালয়গুলিকে সরকারি অনুমোদন দেওয়ার জন্য রাজ্যের শ্রমমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের চেয়ারম্যান দেবাশিস নাগ বলেন, “এলাকার প্রাথমিক বিদ্যালয় ও শিশু শিক্ষা কেন্দ্রগুলিতে এই শিশুদের পড়াশোনা শেখানোর কিছু অসুবিধা রয়েছে। যদি প্রতিটি ইটভাটাতেই এই ধরনের বিদ্যালয় গড়ে ওঠে তাহলে ভাটা শ্রমিকদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষার আলোয় আনা যাবে।” |