সম্প্রতি কলকাতার ইনস্টিটিউট অফ ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের উদ্যোগে আয়োজিত ‘ট্রান্সফর্মিং ডেমোক্র্যাসি’
শীর্ষক
আলোচনাচক্রে পাকিস্তানের শ্রমিক আন্দোলন নিয়ে বলতে এসেছিলেন, লাল-এর মুখ্য গায়ক
তৈমুর রহমান।
বললেন, দেশ, গান আর গানের রাজনীতি সম্পর্কে। শুনলেন
রূপসা রায় |
পাকিস্তানের ব্যান্ডটির নাম ‘লাল’। কেনই বা হবে না! ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ আর হাবিব জালিলের কবিতায় সুর দিয়ে গান গেয়েছিলেন যে ওঁরা। সম্প্রতি উর্দুতে গেয়েছেন ‘ইন্টারন্যাশনাল’-এর মতো গান। ২০০৯ সালের পর দু’টো অ্যালবাম বেরিয়েছে তাঁদের। তার পর থেকেই লাল-এর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। বিশেষ করে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলিতে পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ভারত আর বাংলাদেশে। ফেসবুক প্রোফাইল এবং ইউটিউবে লাল-কে পছন্দ করেছেন প্রায় ৩ লক্ষ মানুষ। গত ১৯ অগস্ট আফগানিস্তানের স্বাধীনতা দিবস উদযাপনকে কেন্দ্র করেও গান গেয়েছে ‘লাল’।
প্রশ্ন: তৈমুর রহমানের আসল পরিচয়টা কী?
তৈমুর: আমার অনেক পরিচয়। তবে প্রথমত, আমি একজন অ্যাক্টিভিস্ট। আমি মার্ক্সিস্ট, অথর্নীতিবিদ, অ্যাকাডেমিশিয়ান, শিক্ষক ও মিউজিশিয়ান।
প্রশ্ন: কিন্তু শেষ পরিচয়টাই তো সব চেয়ে জনপ্রিয়।
তৈমুর: হ্যাঁ, কারণ গান দিয়েই সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছনো যায়।
প্রশ্ন: গান দিয়ে দুনিয়া বদলানোয় বিশ্বাসী?
তৈমুর: হ্যাঁ। তবে এটা আমার বিশ্বাস। কেন না আমার মনে হয়, একমাত্র গানই মানুষকে ছুঁতে পারে। আসলে সুরের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক আদিম। আর সুরের ভিতর যে শব্দগুলো থাকে মানুষকে সেটা ভাবায়।
প্রশ্ন: পাকিস্তানের মানুষ কী চোখে আপনাদের এই উদ্যোগকে দেখে?
তৈমুর: পাকিস্তান খুব গরিব দেশ। আমরা বড় হয়েছি ঠান্ডা যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে। আমাদের প্রজন্ম দেশের মধ্যে একটা নিথরতা দেখেছে। ফয়েজ ছিলেন অবিভক্ত ভারতের প্রগতিশীল লেখকদের একজন। পাশাপাশি তিনি ছিলেন রেল শ্রমিকদের ইউনিয়নেরও প্রেসিডেন্ট। এই অবস্থাটা এখন আর নেই। এখনকার মধ্যবিত্ত মানুষ, যেখান থেকে ফয়েজের মতো ‘অর্গানিক ইন্টেলেকচুয়াল’রা এসেছিলেন, তাঁরা ঘরে ঢুকে গিয়েছেন। ’৭০ এর দশকের পর থেকে দেশে স্থায়ী শ্রমিকের সংখ্যা কমতে শুরু করে। অথচ পাকিস্তানের মতো দেশে যে পরিমাণ কলকারখানা ছিল ওই সময়ে, গত দশকে তা প্রায় দশগুণ বেড়েছে। কিন্তু তাতে শ্রমিক নিরাপত্তা বাড়েনি। পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী চেষ্টা করছে সাধারণ মানুষকে সংসদীয় গণতন্ত্র থেকে সরিয়ে রাখতে। অথচ তাদের কোনও জনভিত্তি নেই। অন্য দিকে, পলিটিক্যাল ইসলাম, মৌলবাদীরা আছে। তারাও আমেরিকা বিরোধিতার যুক্তি দিয়ে সাধারণ মানুষকে সংসদীয় গণতন্ত্রের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখার জন্য প্রভাবিত করছে। যাবতীয় শ্রমিক আন্দোলন ভেঙে গিয়েছে।
জনগণকে ধর্মীয় মৌলবাদের মধ্যে ঢুকে থাকতে বাধ্য করা হচ্ছে। এমনকী, বামেরাও (যেটুকু যা আছে) তাদের অ্যাজেন্ডার সমর্থনের জন্য এই মৌলবাদীদেরযুক্তিই ব্যবহার করছে।
ফলে আমরা যে অবস্থার মধ্যে গান গাইছি, তারও একটা ইতিহাস রয়েছে। আমাদের গান যারা শুনছে, তাদের বেশির ভাগই কিন্তু পাকিস্তানি। তারা গান শুনে ‘রিঅ্যাক্ট’ করছে। কিন্তু তার পরে কী হচ্ছে, জানি না। কারণ সত্যি কথা বলতে, সাধারণ লোক জন চারদিকে কী হচ্ছে, তা নিয়ে মাথা ঘামায় না। নিজেদের মতো করে বেঁচে থাকার চেষ্টা করে। পুরো বিষয়টার সঙ্গে সমঝোতা করে যে ভাবে তাঁরা বেঁচে আছেন, সেটাই তো রাজনীতি।
|
প্রশ্ন: তা হলে দেশের মধ্যে এই অন্য ধারার গান নিয়ে লড়াইটা কী ভাবে চালাচ্ছেন?
তৈমুর: আমি ব্যক্তিগত ভাবে ১৬ বছর ধরে পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ ও শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করছি। তাঁদের নানা ভাবে সংগঠিত করার চেষ্টাও করছি। চার পাঁচ বছর আগে পাকিস্তানে আইনজীবীদের একটা আন্দোলন হয়। তাতে আমরা অংশ নিয়েছিলাম। ২০০৯ সালে আমাদের প্রথম অ্যালবাম বেরোয়। সেই প্রথম আমরা মূল ধারায় এলাম। আমাদের প্রথম অ্যালবাম ‘উম্মিদ-ই-সাহার’, পরেরটা ‘উঠো মেরি দুনিয়া’। তার পর থেকে সাধারণ মানুষের মধ্যে থেকেই সমর্থন আসতে শুরু করল। পাশাপাশি আমরা নানা রকম অসুবিধার মুখোমুখিও হলাম। মৌলবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীলদের থেকে বাধা আসতে লাগল। কিন্তু আমরা এখনও কাজ করছি। বিশেষ করে ছাত্ররা, অধিকার কর্মীরা আমাদের গান গাইতে ডাকছেন। আর সেটাই আমাদের টিকে থাকার জোর বা কৌশল।
প্রশ্ন: আর দেশের বাইরে?
তৈমুর: আমরা চেষ্টা করছি, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে অনুষ্ঠান করতে। আমি গত দু’বছর ধরে মাঝেমধ্যেই ভারতে আসছি। নানা মানুষের সঙ্গে পরিচয় হচ্ছে। সেখানে যেমন বেসরকারি সংস্থাও রয়েছে, তেমনই নাগরিক মঞ্চগুলিও রয়েছে। আমার মনে হয়, এ ভাবেই লড়াইটা চালিয়ে যেতে হবে। |