মন্দিরে ঢোকার লাইনে দাঁড়িয়ে গীতা, দেবী, আরতিরা।
সদর পেরোনোর অনুমতি মিলতে তাঁরা দৌড়ে গেলেন রাসচক্রের দিকে। অনেকেই তখন রাসচক্র ঘোরাচ্ছেন। সোল্লাসে তাঁরাও ঘোরাতে শুরু করলেন রাসচক্র। সাত-সাত বার চক্কর কাটার পরে দূরে দাঁড়িয়ে প্রণামটাও সেরে নিলেন। তার পরে এগিয়ে গেলেন মদনমোহনের মন্দিরের দিকে। চটি খুলে মাটিতে মাথা রেখে প্রণাম করলেন ফের।
অনেক অমিলের মধ্যে ওঁদের এক জায়গায় মিল ওঁরা সকলেই যৌনকর্মী। নবদ্বীপের বিখ্যাত রাসে ব্রাত্য তেলিপাড়া লেনের যৌনপল্লির স্থায়ী বাসিন্দারা। কিন্তু কোচবিহারের রাসমেলায় তাঁদের অবাধ স্বাধীনতা।
|
রাসমেলা ঘুরে আনন্দে মেতে উঠল দৃষ্টিহীন পড়ুয়ারা।
শুক্রবার প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে। |
১৯৬৩ থেকে মদনমোহন মন্দিরে পুজো করে আসছেন হরগৌরী মিশ্র। পুরোহিতের কথায়, “এই মন্দিরের পুজোয় যৌনপল্লির বহু মহিলা অংশ নেন। বহু কাল ধরে এটা হয়ে আসছে। ভগবানের কাছে কাউকে আলাদা করে দেখা হয় না।” মন্দির অফিসের কর্মী জয়ন্ত চক্রবর্তী বলেন, “পনেরো বছর ধরে মন্দিরে চাকরি করছি। কখনও শুনিনি মন্দিরে ঢোকার ক্ষেত্রে কারও বিধিনিষেধ রয়েছে।”
দেবোত্তর ট্রাস্ট বোর্ডের সদস্য কোচবিহারের মহকুমাশাসক বিকাশ সাহা বলেন, “ভগবান নিজেই যদি সবাইকে সৃষ্টি করে থাকেন, সকলে মন্দিরে ঢুকবেন, প্রার্থনা করবেন, এটাই হওয়া উচিত। এই উৎসবের জন্য অপেক্ষা করেন যৌনপল্লির মেয়েরাও। ওঁরা মেলায় যান, আনন্দ করেন। ওঁরা খুশি হলে আমাদের ভাল লাগে।”
মদনমোহন মন্দির ঘিরেই রাসমেলা বসে। কিছু দূরে মাঠে দোকানিরা পসরা নিয়ে বসেন। নাগরদোলা, চিত্রাহার, মৃত্যুকূপ থেকে সার্কাস সবই থাকে। স্টল খুলে নিজেদের পরিষেবার কথা জানান দেয় নানা সরকারি দফতর। মেলা থেকে কিলোমিটার তিনেক দূরে যৌনপল্লি। প্রায় তিনশো পরিবারের বাস। কখনও পনেরো দিন, কখনও বা তার বেশি সময় ধরে চলা মেলা ঘিরে সেখানে উত্তেজনার অন্ত থাকে না।
জন্মাবধি ওই পল্লির বাসিন্দা এক বয়স্কা মহিলার মনে পড়ে, কিছুটা বড় হতেই কখনও মা, কখনও ঠাকুমার হাত ধরে রাসমেলায় যেতেন। প্রথমে মদনমোহন মন্দিরে রাসচক্র ঘুরিয়ে ঠাকুরকে প্রণাম করার পরে মেলার মাঠে যেতেন। ঠাকুমা মারা গিয়েছেন কবেই, মা-ও আর নেই। কিন্তু তিনি এখনও মেলায় যান। গত বছরও তাঁরা দল বেঁধে মেলায় গিয়েছিলেন। এ বারে তিনি এখনও যাননি, কিন্তু পড়শিরা অনেকেই ঘুরে এসেছেন। |
কোচবিহারের মদনমোহন মন্দির। |
প্রবীণার কথায়, “সেই সময়ে এই পল্লিতে এত লোক ছিল না। অল্প কয়েকটি পরিবার থাকত। তাদের বাড়িতে গানের আসর বসত। সামনের রাস্তা দিয়ে গরুর গাড়িতে করে মেলায় যেতেন অনেকে। ঘুরে এসে গানের আসরে যোগ দিতেন।”
লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে মন্দিরে ঢুকে গীতা বললেন, “এই সংস্কার তো সেই ছোটবেলার। রাসে প্রথমেই মন্দিরে যেতে হবে। মদনমোহনকে প্রণাম করে তার পরে মেলায়। এ বারেও তা-ই করেছি।” মেলার মাঠে নাগরদোলার সামনে দাঁড়িয়ে আরতি বলেন, “বছরে এই এক বারই তো নাগরদোলা আসে শহরে। তাই লোভ সামলাতে পারি না।” তবে এই বারে তাঁদের সার্কাস দেখা হয়নি এখনও। মেলা থেকে ফেরার সময়ে একবাক্যে তাই তাঁরা বলে যান, “আবার এক দিন আসব। সার্কাস তো দেখতেই হবে ..।”
|