আবাসন নগরীর ক্ষেত্রে এ বারে বেসরকারি সংস্থাগুলির জন্য জমির ঊর্ধ্বসীমা চব্বিশ একরে বেঁধে দিল সরকার। শুক্রবার বিধানসভায় ভূমি সংস্কার আইনের সংশোধনী এনে এই প্রস্তাব পাশ করেছে রাজ্য ভূমি সংস্কার দফতর। সেখানে এ-ও স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে যে, একমাত্র সরকারি বা যৌথ প্রকল্পের ক্ষেত্রেই ঊর্ধ্বসীমায় ছাড় মিলবে।
রাজ্য এ দিন সংশোধন করেছে ভূমি সংস্কার আইনের ১৪ জেড ধারাটি। জমির সিলিং বা ঊর্ধ্বসীমার সংক্রান্ত বিষয়টি মূলত রয়েছে ১৪ ওয়াই ধারায়। বাম আমলে সেই ধারার সংশোধন করে মিল, ফ্যাকট্রি, ওয়ার্কশপ ইত্যাদির সঙ্গে আবাসন নগরীকেও জুড়ে দেওয়া হয়। যার অর্থ ছিল, আবাসন নগরীর ক্ষেত্রেও চব্বিশ একরের থেকে বেশি জমি কেনার অনুমতি দিতে পারত সরকার। কিন্তু ক্ষমতায় আসার পরে ২০১২ সালে তৃণমূল ওই ধারাটি সংশোধন করে আবাসন নগরীরকে তালিকা থেকে বাদ দেয়। অর্থাৎ, গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে ১৪ ওয়াই ধারায় আর আবাসন নগরী নেই। কিন্তু অন্য ধারাটিতে তা রয়ে গিয়েছে। ভূমি সংস্কার দফতরের বক্তব্য, আর তাতেই হয়েছে বিপত্তি।
ভূমি দফতরের কর্তারা জানাচ্ছেন, এর পরেই ১৪ জেড ধারার সাহায্য নিয়ে এক শ্রেণির প্রোমোটারের মধ্যে এই আইনকে বুড়ো আঙুল দেখানোর প্রবণতা তৈরি হয়। ১৯৭১ সালের আগে যাঁদের চব্বিশ একরের বেশি জমি ছিল (তাঁদের পুরনো বড় রায়ত হিসেবেই চিহ্নিত করা হয়), ওই প্রোমোটাররা তাঁদের সাহায্যে জমি কিনতে শুরু করেন। কারণ, ১৪ জেড ধারা অনুযায়ী ওই রায়তদের আর নতুন করে সরকারি অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন হয় না।
ভূমি দফতরের আরও দাবি, গত দু’বছরে সরকার এমন জমি হাঙরদের প্রায় ৩০০ একর জমি খাস ঘোষণা করে। কিন্তু তাতেও সামলানো যাচ্ছিল না। প্রোমোটাররা আদালতে চলে যাচ্ছিলেন। সেখানে তাঁরা উদাহরণ হিসেবে তুলে আনছিলেন ১৪ জেড ধারায় অতিরিক্ত জমি রাখার বিষয়টি। ভূমি দফতরের এক কর্তা বলেন, “সরকার যখন ১৪ ওয়াই ধারা থেকে আবাসন নগরী বাদ দিয়েছিল, তখনই জেড ধারা থেকেও তা বাদ দেওয়া উচিত ছিল। এই দুর্বলতার সুযোগে অনেকেই নতুন করে জমি কিনে নেন।” ওই কর্তা জানাচ্ছেন, এই ভুল সংশোধন করতেই শেষ পর্যন্ত ১৪ জেড ধারা থেকেও আবাসন প্রকল্পের বিষয়টি বাদ দেওয়া হল।
এই যুক্তিই শোনা গিয়েছে ভূমি রাজস্ব দফতরের প্রতিমন্ত্রী স্বপন দেবনাথের মুখেও। তিনি জানান, গত বছর মে মাসে বর্তমান সরকার ১৪ ওয়াই ধারায় সংশোধনী এনে চব্বিশ একরের বেশি জমিতে বেসরকারি নগর গড়ার অনুমোদন প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। কিন্তু ১৪ জেড ধারায় প্রকল্প এলাকার মধ্যে নগর গড়ার বিষয়টি থেকে গিয়েছিল। এ বার সেটিও বাদ দেওয়া হল। পরে সভার বাইরে মন্ত্রী জানান, যে কোনও স্থানে নগর বা টাউনশিপ তৈরির অধিকার একমাত্র সরকারের হাতে রাখার নীতি নেওয়ার জন্য এ দিনের সংশোধনী।
কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে অন্যত্র। জমি হাঙরদের সামলাতে সরকার যে ব্যবস্থা নিল, তাতে বড় আবাসনে বেসরকারি লগ্নি আসার পথই তো প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। যার ফলে বড় ধাক্কা খেতে পারে নগরায়ন। বিরোধীরা নন, এই নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন খোদ রাজ্যের পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। সংশোধনীর কথা শুনে বিস্মিত ফিরহাদ বলেছেন, “আমি তো এমন সংশোধনীর কথা জানি না। যদি এমন হয়ে থাকে, তা হলে তা রাজ্যের নগরায়নের ক্ষেত্রে বড় ধাক্কা।” তাঁর বক্তব্য, “কোনও বেসরকারি সংস্থা নিজেরা জমি কিনে আবাসন তৈরি করতে চাইছে, অথচ সরকার অনুমতি দিচ্ছে না এমন যদি হয়, তা হলে তো আগামী দিনে আবাসন প্রকল্পে এ রাজ্যে বড় বিনিয়োগ আসার সম্ভাবনা কম।” এর মন্দ দিকটি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, “এর ফলে আরও বেশি করে অপরিকল্পিত নগরায়ন হবে।”
প্রায় একই কথা বলেছেন বাম আমলের ভূমি রাজস্ব মন্ত্রী রেজ্জাক মোল্লাও। তাঁর আমলেই আবাসন প্রকল্পে অতিরিক্ত জমি রাখার ব্যবস্থা হয়েছিল। রেজ্জাকের কথায়, “আমরা আবাসন প্রকল্পে বেসরকারি বিনিয়োগ টানতে আইনে এই ব্যবস্থা রেখেছিলাম। এখন সরকার যদি বাড়ি-ঘর নির্মাণেও নামতে চায়, তা করতেই পারে। আমরা বিরোধ করতে যাব কেন? কিন্তু দেশে কোথাও কি সরকার আবাসন নগরী কেবলমাত্র নিজের হাতে রেখেছে?”
এই একই প্রশ্ন উঠেছে প্রশাসনের একাংশের মধ্যেও। অনেকেই বলছেন, সরকারের কাজ কি আবাসন প্রকল্প তৈরি করা? জমি হাঙরদের সামলাতে বরং অন্য আইনি ব্যবস্থা করা যেত। এ তো নাক কেটে যাত্রাভঙ্গের সামিল হল। এর পরে কি আর আবাসনে বড় বিনিয়োগ আসবে?
এই সংশোধনীর কথা জানার পরে নির্মাণ সংস্থাগুলির সংগঠন ক্রেডাই-এর অনেকেই আবাসন শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। যদিও ক্রেডাই-এর সদস্য সুশীল মোহতা বলেছেন, “রাজ্যে এক লপ্তে চব্বিশ একর জমি পাওয়াই তো দুষ্কর ছিল। তাই এই সংশোধনীর ফলে পরিস্থিতি খুব বেশি বদলাবে না।” তাঁর যুক্তি, এই রাজ্যে জমি ছোট ছোট টুকরোয় বিভক্ত। তাই চব্বিশ একরের বেশি জমি কিনতে গেলে অনেক বেশি জমি মালিকের সঙ্গে কথা বলতে হয়। এক লপ্তে বড় জমি নিয়ে সমস্যা ছিলই। |