পুস্তক পরিচয় ১...
যদি আর একটু অনুসন্ধান করতেন...
ইয়াং টেগোর: দ্য মেকিংস অব আ জিনিয়াস, সুধীর ককর। পেঙ্গুইন ভাইকিং, ৪৯৯.০০
সাইকোবায়োগ্রাফি’ শব্দটির বাংলা কী? আদতে তা কোনও ব্যক্তির মনস্তাত্ত্বিক ইতিবৃত্ত, তাঁর শৈশব থেকে শুরু করে নানা ঘটনা, পরিবেশ এবং প্রবণতার বিচারের শেষে খাড়া করা এক ভাষ্য। সুধীর ককরের অভীষ্ট তিনি নিজেই খোলসা করেছেন। তাঁর উদ্দেশ্য রবীন্দ্রনাথের সাইকোবায়োগ্রাফি রচনা, যে পূর্বাপর ভাষ্যের কেন্দ্রে রয়েছেন ছেলেবেলা ও কৈশোর-অতিক্রান্ত কবি।
প্রকল্পটির মধ্যে অভিনবত্ব নেই। ককর বলেছেন যে, ঐতিহাসিক জীবনীকার এবং মনোজীবনের ভাষ্যকারের মধ্যে তফাতের কথা রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলে গেছেন তাঁর জীবনস্মৃতি গ্রন্থের গোড়ার দিকে। অবশ্য এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ আগেই তাঁর ‘কবিজীবনী’ প্রবন্ধে কিছু মন্তব্য করেছেন। এটি ছিল ইংরেজ কবি টেনিসনের একটি জীবনীর সমালোচনা, এবং এর ইংরেজি অনুবাদ অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস প্রকাশিত রবীন্দ্র-রচনার সংকলনে সহজলভ্য। এই প্রবন্ধটির হদিশ সুধীর ককরের ছিল, এমন কোনও সাক্ষ্য তাঁর বইটিতে নেই।
১৯৬২ সালে জগদীশ ভট্টাচার্যের কবিমানসী বইটি প্রথম বেরোয় ডি এম লাইব্রেরি থেকে। সত্যি বলতে কি, ককরের সাইকোবায়োগ্রাফির গতিপথ এবং পর্বভাগ জগদীশ ভট্টাচার্যের অনুবর্তী। কবিমানসী-র ইংরেজি তর্জমার উল্লেখ করেছেন ককর, যদিও ঝাপসা কোনও কারণে টীকা ও গ্রন্থপঞ্জিতে সেটি ‘কবিমানুষী’ হয়ে গেছে। গত পঞ্চাশ বছরে এ বিষয়ে বিস্তর লেখালেখি হয়েছে। বুদ্ধদেব বসু, শঙ্খ ঘোষ, শিশিরকুমার দাশ, রতন পারিমু ও তপোব্রত ঘোষের রচনা ইংরেজিতেও ইতস্তত পাওয়া যায়, কিন্তু ককর সে-সবের দিকে দৃক্পাত করেছেন বলে মনে হল না। তিনি যে-সব হালের ইংরেজি বই নেড়েচেড়ে দেখেছেন, যেমন উমা দাশগুপ্ত বা সব্যসাচী ভট্টাচার্যের বই, তাতে সাইকোবায়োগ্রাফি লেখার মালমশলা তেমন নেই। প্রশান্তকুমার পালের রবিজীবনী-র তিন খণ্ড গ্রন্থপঞ্জিতে রয়েছে বটে, কিন্তু ২০১৩ সালে প্রকাশিত বইয়ের প্রাক্-কথনে প্রথম পৃষ্ঠায় ককর প্রশান্তকুমারের রবিজীবনী কেবল পাঁচ খণ্ডের কীর্তি বলে রাষ্ট্র করলে তাঁর বাকি বই সম্পর্কে ভয়ে মন সিঁটিয়ে থাকে।
ককর তাঁর কাহিনি শুরু করেছেন নিজের কথা দিয়ে। কেন তিনি রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে সন্দিগ্ধ ছিলেন, তার বেশ কয়েকটি কারণের মধ্যে একটি হল কবির ঢিলেঢালা পোশাক এবং তাঁর দাড়ি। দু ’টিই যে ভারতের পাঠান-মোগল আধিপত্যের উত্তরাধিকার, সেটি ককর তাঁর নিজের বইয়ের ছাপা প্রতিকৃতিগুলি দেখলেই বুঝতেন। এই পরম্পরায় ঠাকুর পরিবারের নিজস্ব উদ্ভাবনার সূক্ষ্ম বিচারের মধ্যে অবশ্য তিনি যেতে চাননি। আরেকটি কারণ, রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বাঙালিদের স্বত্ববোধ এবং স্পর্শকাতরতা। এই উদ্ভট অভিযোগ এ দেশের অন্য অঞ্চল থেকে যতখানি তোলা হয়, ততখানি বিদেশ থেকে নয়। গড়পড়তা বাঙালি কারণে-অকারণে রবীন্দ্রসংগীত গেয়ে ওঠেন বটে, সেটা হয়তো বাঙালির বিরক্তিকর বদভ্যাস। তাতে অবশ্য রবীন্দ্রনাথের কবিতাকে ভিত্তি করে লেওস জানাচেক বা আল্লারাখা রহমানের নতুন সংগীত সৃষ্টিতে কোনও অসুবিধা হয়নি। সাধারণ মানুষের সংস্কৃতিমনস্কতা এক জিনিস, পণ্ডিত ও স্রষ্টার আগ্রহ আর এক। ককরের মতো নালিশ আবু সয়ীদ আইয়ুব অথবা দুসান জাভিতেল কখনও তোলেননি। ককরের মাতৃভাষায় বালজাক-এর সার্থক তরজমা আছে কি না জানি না। এর জন্য কেউ ফরাসিদের দোষ দিলে তা বোধহয় ন্যায্য হবে না।
এরপর ককর রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর মায়ের ব্যবধান এবং ভৃত্যতন্ত্রের শাসনে বড় হয়ে ওঠা বালকের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলিয়ে ‘শিশু’র কয়েকটি কবিতার আলোচনা করেছেন। এই অংশটিতে ককরের বৈদগ্ধ্য এবং মনঃসমীক্ষক হিসেবে তাঁর অভিজ্ঞতা খুবই স্পষ্ট। কিছু আপত্তির হেতু অবশ্য থেকে যায়। মাতৃস্নেহ থেকে নির্র্বাসিত, মাইনে-করা কর্মীদের পীড়নে ক্ষুব্ধ বালকের স্মৃতির এক ধরনের প্রতিসরণ ঘটেছে ‘শিশু’-র কবিতায় বা ‘পোস্ট মাস্টার’ গল্পে, এমনই ককরের অনুমান। মধ্যবর্তী সময়টুকুতে রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী-বিয়োগ, অন্যান্য রচনায় শৈশব প্রসঙ্গ এ সবের কোনও কিছুই ককরের আলোচনায় নেই। ‘পোস্ট মাস্টার’ গল্প যে একই সঙ্গে শঙ্কর-ভাষ্য এবং পুরুষতন্ত্র বিষয়ে মৃদু কটাক্ষ, সে কথাও ককরের নজর এড়িয়ে গেছে।
ইস্কুলে রবীন্দ্রনাথ অন্য ছেলেদের অত্যাচার সহ্য করতে পারেননি, তাঁর পৌরুষে তা ঘা দিয়েছিল এ কথার মধ্যে কিছু যুক্তি আছে। রবীন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতি পড়লে অন্তত সে রকম মনে হয়। অথচ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনস্মৃতি অন্য রকম সাক্ষ্য দিচ্ছে। সেখানে বালক রবি নিরস্ত্র অবস্থায় পায়ে হেঁটে তাঁর দাদার সঙ্গে বাঘ শিকারে নামছেন, গুপ্ত সমিতিতে যোগ দিচ্ছেন, সম্পূর্ণ অজানা লোকের বাড়িতে পরিচয় ভাঁড়িয়ে গাছ থেকে পাড়িয়ে ডাব খাওয়া উপভোগ করছেন। রবীন্দ্রনাথের এই আংশিক স্মৃতিভ্রম সম্পর্কে বিদগ্ধ মনঃসমীক্ষকের মন্তব্য প্রয়োজন ছিল। বস্তুত ককরের গবেষণায় কিছুটা শৈথিল্য পাঠককে অস্বস্তিতে ফেলবে। রবীন্দ্রনাথের জন্মের সময় তাঁর মা-র বয়স ছিল চুয়াল্লিশ, এই তথ্যটি বিতর্কিত। কানা পালোয়ানকে ‘blind wrestler’ বলা বোধহয় ঠিক নয়, ঠিক যেমন সোমেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ‘সৌমেন্দ্রনাথ’ বলাটাও বেঠিক। এবং সুরুলের শ্রীকণ্ঠ সিংহকে অন্য শিক্ষকদের সঙ্গে এক সারিতে ঠেলে দেওয়াও বিভ্রান্তিকর।
রবীন্দ্রনাথ পিতৃগ্রস্ত ছিলেন। কথাটা গোলাম মুরশিদকে বলতে শুনেছিলাম। ককর নিপুণ ভাবে দেখিয়েছেন যে, রবীন্দ্রনাথের পিতৃভক্তির মধ্যেও একটি নীরব প্রতিবাদ ছিল। বইটির এই অংশ সুলিখিত ও সুচিন্তিত, যদিও ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠায় দেবেন্দ্রনাথের অবদান সম্পর্কে লেখকের ধারণা খুব স্পষ্ট নয়। আরও অস্পষ্ট ঠাকুরবাড়ির ব্রাহ্ম ও হিন্দু অংশের মধ্যে সম্পর্কের টানাপড়েন বিষয়ে তাঁর জ্ঞান। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও গুণেন্দ্রনাথের সখ্য কী করে কনিষ্ঠের প্রতিভা লালন করেছিল, তা জানলে লেখকের খানিকটা সুবিধা হত।
এই ধরনের বইয়ের কেন্দ্রস্থলে অবধারিত ভাবে থাকবে কাদম্বরীর কাহিনি। এখানে ককর নতুন কিছু বলেছেন বলে মনে হয় না, যদিও তাঁর কিছু মন্তব্য অত্যন্ত বিচক্ষণ। শুধু দু’টি অস্বস্তির কথা বলতে চাই। এক, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ব্যর্থকাম ছিলেন এবং রঙ্গমঞ্চের নটীদের সঙ্গপ্রার্থী ছিলেন এ গুজবের আদৌ কোনও ভিত্তি নেই। মনে রাখতে হবে, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সংস্কৃত সাহিত্যের অধিকাংশ নাটক বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন, মঞ্চসফল মৌলিক নাটক লিখেছিলেন, ফরাসি থেকেও তাঁর তরজমা সমাদৃত ছিল, চিত্রাঙ্কনে ও সংগীত রচনায় তাঁর প্রতিভার কথা বাংলার সুধীসমাজ জানত। দুই, কাদম্বরীর সঙ্গে বিহারীলাল চক্রবর্তী বা ঠাকুর পরিবারের অন্যদের সম্পর্ক একেবারেই খতিয়ে দেখেননি ককর। শুধুমাত্র স্বর্ণকুমারী দেবীর কন্যার প্রতি কাদম্বরীর স্নেহের কথা রয়েছে। যদি খানিকটা অনুসন্ধান করতেন, তা হলে হয়তো কেবলমাত্র ‘তারকার আত্মহত্যা’, ‘ছবি’ এবং ‘নষ্ট নীড়’ নয়, অনেক কবিতা ও কাহিনির নজির টেনে ককর তাঁর সিদ্ধান্ত জোরালো করতে পারতেন।
শেষ দু’টি অধ্যায়ে আছে রবীন্দ্রনাথের আঁকা প্রতিকৃতি ও তাঁর প্রতিভার চরিত্রের আলোচনা। ছবির ব্যাখ্যা কিছুটা সংক্ষিপ্ত হলেও মূল্যবান, বিশেষ ভাবে যেখানে তিনি মনঃসমীক্ষকের দৃষ্টিতে ছবিগুলি বিচার করেছেন। পাঠকের মনে হতেই পারে যে, ছবির মধ্যে রবীন্দ্রনাথ তাঁর আত্মপরিচয় বিলোপের যতখানি চেষ্টা করেছেন, তাঁর অতীত অবসাদ ও অপরাধবোধের নিরাময়ের ততটা নয়। সৃজনশীল প্রতিভা সম্পর্কে ককরের পড়াশোনা বিস্তৃত, এবং তিনি পুব-পশ্চিমের পাণ্ডিত্যকে এই পরিচ্ছেদে শামিল করেছেন। শেষ বিচারে, তাঁর মতে রবীন্দ্রনাথের প্রতিভা কেবল ব্যক্তির অন্তরের সৃজনক্ষমতা নয়, তা মহাবিশ্বের সৃষ্টি-বিলয়ের সুরের সঙ্গে বাঁধা। রবীন্দ্রনাথের জীবনদেবতার ধারণা সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে অনুরূপ কথা বলেছিলেন ১৯২৯ সালে নীহাররঞ্জন রায়, তাঁর ‘রবীন্দ্র প্রতিভার উৎস’ প্রবন্ধে। তার কোনও উল্লেখ ককরের বইতে পেলাম না, যদিও প্রবন্ধটি ইংরেজি ভাষায় অনূদিত।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.