শনিবারের নিবন্ধ
বালাই ৬৫
• তালাবন্ধ ঘরে একা রেখে সবাই বেরিয়ে যেতেন কাজে।
• একা বাড়িতে উঠতে গিয়ে পড়ে গেলেও তুলে ধরার কেউ থাকত না।
• দুপুরের খাবারটুকু বাড়িয়ে দেওয়ার কেউ ছিল না।
• চাইলেই যে কারও সঙ্গে দেখা করতে পারতেন, এমন নয়।
মান্না দে। এত বড় মাপের মানুষের এই পরিণতি দেখে আতঙ্কিত অনেকেই মান্না দে’রই যদি এমন হয়, তবে আমাদের কী হতে পারে...!
উল্টো ছবিটা দেখুন।

• স্বামী মারা যাওয়ার পর জীবন থমকে গিয়েছিল কামালগাজির ষাটোর্ধ্ব ঈশানী ভট্টাচার্যের। ছবি আঁকা, বই পড়া কিছুতেই মন লাগত না। এখন তিনি মূলস্রোতে।
• বালিগঞ্জের গৃহবধূ অপর্ণা চক্রবর্তী। বয়স বাষট্টি। ছেলেমেয়ে বিদেশে। স্বামী ব্যস্ত ডাক্তার। একাকী লাগত এক সময়। এখন সে সব ঝেড়ে ফেলেছেন।
• পাঁচ বছর আগে একমাত্র মেয়ে মারা গিয়েছে ভবানীপুরের সুকন্যা সিনহার। বয়স প্রায় সত্তর। গভীর হতাশায় ডুবে গিয়েছিলেন। আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। এ বারের পুজোয় জমকালো এক সেট কসটিউম জুয়েলারি কিনেছেন নিজের জন্য।

কী ভাবে এমনটা সম্ভব হল?

ঈশানীর কথা দিয়েই শুরু হোক। একবার ভেবেছিলেন বৃদ্ধাশ্রমে চলে যাবেন। কিন্তু বাড়িতে যে বড় মায়া। হঠাৎ একটি বাংলা ম্যাগাজিনে বয়স্কদের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের খোঁজ পান তিনি। তার সঙ্গেই যুক্ত হয়ে যান।
মেয়ে বিদেশ যাওয়ার পর অবসাদ কাটাতে অপর্ণা ওই একই প্রতিষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন। এই সংস্থার আর এক সদস্য পথিক বন্দ্যোপাধ্যায়। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর পাটুলির বাড়িতে একাই থাকতেন। পুত্রবধূ মুম্বইয়ে বসে শ্বশুরকে সদস্য করে দেন সংগঠনটির। ওখানে যাওয়ার অল্প কিছু দিনের মধ্যেই ওঁরা একেবারে অন্য মানুষ।
জীবনের দ্বিতীয় ইনিংসটা ভাল করে খেলতেই জোট বেঁধেছেন ওঁরা। সারা বছর গান, সিনেমা, বেড়ানো, আড্ডায় ভরিয়ে রাখেন নিজেদের।
ছেলেমেয়েদের কাছে না পাওয়া বা সঙ্গীর বিচ্ছেদ সব এক পাশে সরিয়ে জীবনে এগিয়ে চলতে ওঁদের দাওয়াই ফি-হপ্তায় কিছুটা সময় একসঙ্গে কাটানো। ব্যস্।
পঁয়ষট্টি বছর বয়স যেন একটা সীমারেখা। এর পরই সূর্য হেলতে শুরু করে। সন্তান থাকুক বা না থাকুক, প্রথম প্রশ্ন, শেষ জীবনে কে দেখবে?
তার ওপর কেউ নানা রোগে ভুগে অতিষ্ঠ, কারও বা দীর্ঘ দিনের সঙ্গী চলে যাওয়ার শোক। কখনও কাছের মানুষের অসংবেদনশীল আচরণ, তো কখনও সন্তান-হারানো। এক ধাক্কায় আরও বেশি বুড়িয়ে যাওয়া। সেখান থেকেই ‘এ বার গেলেই বাঁচি’। শুরু হয় শেষের সে-দিন গোনা।
সামাজিক অবস্থান খানিকটা লঘু হওয়া বা লস অব স্টেটাস আর আর্থিক দিক দিয়ে আগের তুলনায় রুগ্ণতা অবসরের পর প্রথম ধাক্কাটা মূলত এই দুই কারণেই বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। জেরেন্টোলজিস্ট ইন্দ্রাণী চক্রবর্তীর মতে, “সারাক্ষণ বাড়ি আর ছেলেমেয়ে নিয়ে ভাবতে গিয়ে বেশির ভাগ মানুষ এমন ঘোরে জীবন কাটান যে, তার বাইরে নিজেদের অস্তিত্বের কথা ভুলেই যান। এক সময় শুরু হয়ে যায় কী করলাম আর কী পেলাম তার হিসেব। সেখান থেকেই একাকীত্ব, বিষাদ, হতাশার কবলে পড়া।”
মডেল: অনুরাধা রায়, চণ্ডীদাস কুমার।
ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল।

বৃদ্ধাশ্রম গেলেই তো হয়
ঝক্কি নেওয়ার কী আছে? বৃদ্ধাশ্রমে থাকা যায়। শেষ বয়সের নিশ্চিন্ত ঘাঁটি! একবার পা ফেললেই মুশকিল আসান। এ ভাবে অনেকেই বৃদ্ধাশ্রমের কথা ভাবেন।
তবে ফিজিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড রিহ্যাব বিশেষজ্ঞ ডা. মৌলিমাধব ঘটক বললেন, ‘শারীরিক, মানসিক ও পুষ্টিগত যে সব চাহিদা বৃ্দ্ধ-বৃদ্ধাদের রোজকার জীবনে দরকার, তা কিন্তু অনেক বৃদ্ধাশ্রমেই মেলে না। কিছু কিছু জায়গায় আবার একটি ঘরের মধ্যে অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় অনেক মানুষকে যে ভাবে রাখা হয়, তা মানবিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দেয়।” তা ছাড়া বহু দিনের অভ্যস্ত জীবন থেকে আবার নতুন জীবনে মানিয়ে নেওয়া আর প্রিয় মানুষদের কাছ থেকে দূরে থাকা এঁদের অবসাদে নতুন মাত্রা যোগ করে।
এর পর তো আছে খরচখরচার ব্যাপারস্যাপার। বৃদ্ধাশ্রমের খরচ কমপক্ষে মাসে ২,০০০ টাকা থেকে শুরু করে ৩০,০০০ বা তারও বেশি হতে পারে। বেশির ভাগ বৃদ্ধাশ্রমই এককালীন টাকা ডিপোজিট রাখে। তার পরিমাণ কোথাও দুই লক্ষ, তো কোথাও পঁচিশ লক্ষ।
কালীঘাটের এক বৃদ্ধাশ্রম কর্তৃপক্ষ জানালেন, সেখানে এককালীন সাড়ে ৫ লক্ষ টাকা জমা রাখতে হয়। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার দরকার হতে পারে, তাই তার কথা ভেবে আলাদা করে দেড় লক্ষ টাকা জমা রাখা হয়। আর মাসে মাসে ২৮,০০০ টাকা। এর বাইরে ছোটখাটো অসুখ-বিসুখ আছে। তখন ডাক্তার, ওষুধের খরচা নিজেদের। অনেক ক্ষেত্রে একা বৃদ্ধকে এরা রাখতে চান না। বা রাখলেও অসুস্থ হয়ে পড়লে হাসপাতালে ভর্তি করে বাড়ির লোককে খবর দেওয়া পর্যন্ত দায়িত্ব তাঁদের। এ শুধু এখানকার ছবি নয়। অনেক জায়গাতেই।
ফলে অনেকেই আজকাল বৃদ্ধাশ্রম-এর লক্ষ্য থেকে বেরিয়ে এসে নতুন করে ভাবছেন।
কী সেই ভাবনা?

সোশ্যাল প্ল্যানিং
‘বালিগঞ্জ কোর্ট’ সিনেমার সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে মনে আছে?
একমাত্র ছেলের বিদেশে চাকরি করতে যাওয়া আটকাতে বদ্ধপরিকর ছিলেন বৃদ্ধ। অনেক বুঝিয়ে স্ত্রী ছেলেকে বিদেশে পাঠান। এর পর শূন্যতা ঘিরে ধরে দম্পতিকে। অভিমানে স্ত্রী-র মৃত্যুসংবাদও ছেলেকে দেননি বৃদ্ধ।
ইন্দ্রাণীদেবীর সোজাসাপটা বক্তব্য, “চাকরিজীবনে ছেলে কিংবা মেয়েকে বিদেশ বা অন্য রাজ্যে যেতে হতেই পারে। তখন ‘অভিমান’ বা ‘অনুযোগ’ করাটা কাজের কথা নয়। বরং সময় থাকতে ছেলেমেয়ের প্রতি কর্তব্য করেও, নিজেদের জগৎটাও সাজান। আগেভাগেই করুন সোশ্যাল প্ল্যানিং।”
সোশ্যাল প্ল্যানিং? সেটা কী বস্তু? শেষ বয়সে কে দেখবে, নির্ভর করবেন কার বা কাদের ওপর সোজা কথায় এ নিয়েই হবে আপনার এই প্ল্যানিং।
কসবার মনোশ্রী আর অম্লান বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুই ছেলেই থাকেন আমেরিকায়। একা থাকতে হবে জেনে দম্পতি যোগ দিয়েছিলেন পরিচিতদের একটি দলে। সদস্যরা সব্বাই ষাটোর্ধ্ব। মাস কয়েক আগে অম্লানবাবু হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে অপারেশনের সময় পাশে পেয়েছিলেন ষাটোর্ধ্বদের সেই দলটিকে।
ওই দলেরই ডা. প্রণব বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, “আমাদের লিস্ট করা আছে কার কী ধরনের অসুবিধা। এমনকী কার রক্তের কী গ্রুপ, তা’ও। যাতে দরকারের সময় অসুবিধে না হয়। নিজেদেরটা তো নিজেদেরই করতে হবে।” এই ভাবে পরস্পরের প্রতি হাত বাড়িয়ে নতুন ভাবে জীবন কাটাচ্ছেন ওঁরা।
ভবিষ্যতে টাকাপয়সার জোগান, বা স্বাস্থ্যবিমার মতো মূল্যবান ভাবনাটিও কর্তা-গিন্নি দুজনে মিলেই ছকে নেওয়া ভাল। বিশ্বস্ত পরিজন, নিকট-বন্ধুর বা পেশাদারদের পরামর্শও নেওয়া যেতেই পারে।
“চাকরি পাওয়ার দুই-তিন বছর পরই অবসর-পরবর্তী পরিকল্পনা শুরু করা উচিত। যত দেরিতে এই প্ল্যান শুরু করবেন, ফি-মাসে তত বেশি টাকা জমাতে হবে।” বললেন ফিনান্সিয়াল অ্যাডভাইজার শৈবাল বিশ্বাস। তাঁর মতে, অবসরের পর স্ট্যান্ডার্ড অব লিভিং ধরে রাখতে, ‘প্রজেক্টেড ইনকাম’-এর হিসেব করে সেভিংস বা ইনভেস্টমেন্টের প্ল্যান করা উচিত। অর্থাৎ, ওই সময়ে কত টাকা মাসে মাসে হাতে এলে আজকের মতো করে বাঁচা যাবে।

ভাল থাকতে
জেনারেল ফিজিশিয়ানের পাশাপাশি জেরিয়াট্রিশিয়ানের পরামর্শ নিন
চাকরি বা পেশাজীবনে ঢোকার পরই দেরি না করে ‘ফিনান্সিয়াল অ্যাডভাইজারের’ সঙ্গে সেভিংস বা ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যান নিয়ে কথা বলুন
আগেভাগে শেষ বয়সের জন্য একটা ‘সোশ্যাল প্ল্যানিং’ থাকা দরকার
কাছের কোনও সংস্থার সঙ্গে যুক্ত হন। আশপাশের লোকজনের সঙ্গে সদ্ভাব রাখুন। ভাল কমপ্লেক্সে থাকার সামর্থ্য থাকলে তাই-ই করুন
বয়স্কদের সাহায্য করেন, এমন সংস্থায় নাম রেজিস্ট্রি করান
নিজের ভাল লাগা কিছুর সঙ্গে যুক্ত হন। প্রয়োজনে প্রি-রিটায়ারমেন্ট কাউন্সেলিং করে জেনে নিন আপনার পোটেনশিয়ালিটি
সারা দিন শুয়ে বসে, টিভি দেখা নয়। সুযোগ পেলেই বেড়িয়ে আসুন। পার্কে, কফি শপে আড্ডা দিন। থিয়েটার, সিনেমা। বাড়ির টুকটাক কাজ। নিয়মিত শরীর চর্চা। মেডিক্যাল চেকআপ ছ’মাস অন্তর
ঘরে স্মৃতি জড়ানো বিশেষ কোনও ছবি, টুকরোটাকরা জিনিসপত্র মনোকষ্টের কারণ হলে চোখের আড়ালে রাখুন
সমস্ত দরকারি ফোন নম্বর রাখুন হাতের নাগালে
ঘরদোর থাকুক চনমনে, প্রাণবন্ত

ব্যস্ত রাখুন নিজেকে
অবসরের পর ‘হোম ডিপার্টমেন্ট’ সামলাতে উঠে পড়ে লেগেছেন বাঘাযতীনের জুড়ান গঙ্গোপাধ্যায়। বাজারদোকান থেকে সংসারের যাবতীয় কাজ এখন নিজে করেন। সবই শরীরকে সচল রাখতে। তাই অবসরের পনেরো বছর পর এখনও দৌঁড়ঝাপ করতে পারেন পঁচাত্তর বছরের বৃদ্ধ।
জেরেন্টোলজিস্টদের (বয়স্কদের চিকিৎসক) পরামর্শও তাই, সচল থাকুন। তাঁদের কথায়, “এত দিন সময়ের অভাবে যা যা করতে পারেননি, মন দিতে পারেন তাতেও। বিষণ্ণতা থাবা বসাতে পারবে না।” এ ক্ষেত্রে প্রি-রিটায়ারমেন্ট কাউন্সেলিং করে আজকাল অনেকেই নিজের মধ্যে এক ‘অন্য আমি’-কে আবিষ্কার করছেন। জানতে পারছেন, নিজের পোটেনশিয়ালিটি। কী ধরনের কাজ তাঁদের উপযুক্ত। সেই অনুযায়ী কাজে যুক্ত হচ্ছেন।
ঈশানী, অপর্ণাদের কেউ গান শিখছেন। শিখে নিচ্ছেন সোশ্যাল নেটওয়ার্কিংটাও।
আর মাঝেমধ্যে নাটক করা বা সিনেমা দেখা, কফি শপে আড্ডা, দল বেঁধে বেড়াতে যাওয়া সব মিলিয়ে ওঁরা এখন বেয়াড়া টাট্টু না হলেও মনের দিক থেকে বেশ টগবগে তো বটেই। এই মনোভাবই ওঁদের চাঙ্গা করেছে বলে জানাচ্ছেন মনোবিদরা।
মনোবিদ এ কে রায় জানালেন, “অনেক সময়ই এঁরা বাতিলের দলে পড়ে যান। সংসার বা অর্থনৈতিক অনেক ব্যাপারে আগের মতো স্বাধীনতা আর থাকে না। ব্যাপারগুলো সহজ ভাবে নিতে না পারলে আসে হীনমন্যতা। এই হীনমন্যতা কাটাতে নিজের মতো করে বাঁচার পথটা খুঁজতেই হবে।”
একমাত্র সন্তানের মৃত্যুশোক পেয়েছেন, গ্রুপের এ রকম সদস্যদের সমব্যথী হয়েও ওঁরা পাশে দাঁড়ান। শোকের মধ্যেও সেই মানুষগুলো নতুন করে বাঁচার দিশা পান। যাঁরা শয্যাশায়ী, বাড়ি থেকে বেরোতে পারেন না, তাঁদের সঙ্গ দেওয়া থেকে ছোটখাটো ব্যাঙ্কের কাজের মতো প্রয়োজনীয় টুকিটাকি দরকার সামলে দেন এঁরা।
তাতে ফল যা হয়েছে তার নমুনা পাওয়া গেল তাঁদেরই একজন সদস্যের কথায়। তিনি বলছিলেন, “আগে ছেলেমেয়েরা খোঁজখবর না করলে অভিমান হত। রাগ হত। আরও যেন একা লাগত। এখন ছেলেমেয়েদের পাল্টা অভিযোগ, ফোন করব কী, তোমরা সারা দিন এত ব্যস্ত থাকো...।”
তবে চাইলেই তো সবার হাতের কাছে এমন সংগঠন মিলবে না। তখন?
বিশেষজ্ঞরা এ সব ক্ষেত্রে পুরনো আপ্তবাক্যটাই স্মরণ করান, ‘ইচ্ছে থাকলেই উপায় হয়’।
পাড়ার ক্লাব, বা লাইব্রেরি, নিদেনপক্ষে মর্নিংওয়াকের সঙ্গী... কিছু একটা পাবেনই। ঢাকুরিয়ার অনুরাধাদেবী যেমন। বছর কয়েক হল এক ‘বার্ড ওয়াচার্স ক্লাব’-এর সদস্যা। দিব্যি আছেন তিনি পাখিদের সংসারে।
ডোভার লেনের ছেষট্টি বছরের সুকল্যাণ চট্টোপাধ্যায় আবার নিজেকে সঁপে দিয়েছেন প্রবীণ অসুস্থ মানুষদের সেবাযত্নে। বৃদ্ধা স্বাধীনতাসংগ্রামী আত্মজীবনী লিখবেন, হাত চলে না, সুকল্যাণ অনুলেখকের ভূমিকায়। পরিবারে কোণঠাসা নিঃসঙ্গ বৃদ্ধবৃদ্ধাদের পারিবারিক সমস্যা মেটাতেও তিনি আছেন। রাখেন নানা রকমের বৃদ্ধাশ্রমের খোঁজও। কারও দরকার হলে, তাঁর আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ী ব্যবস্থাও করে দেন।


আছেন ওঁরা
যাঁরা এমনিতে রোগগ্রস্ত, বিছানায় শয্যাশায়ী, তাঁরা?
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, “এই সমস্যা তো এক দিনে হয় না, যে কারও যে কোনও দিনই হতে পারে। ফলে আগেভাগেই জোটবদ্ধ ভাবে বাঁচার চেষ্টা করাটা জরুরি।” এ দিক থেকে সামর্থ্য থাকলে কোনও কমপ্লেক্সে থাকাটা ভাল। আর দরকার কিছু সংস্থার সাহায্য নেওয়া। যাঁরা শুধুমাত্র বয়স্কদের দেখভালের জন্য কাজ করছেন।
ইন্দ্রাণীদেবী জানালেন, ভারত সরকারের সামাজিক ন্যায় ও অধিকার প্রদান মন্ত্রক বৃ্দ্ধ-বৃদ্ধাদের কথা ভেবেই তরুণ-তরুণীদের নিয়ে তৈরি করেছে ‘জেরিয়াট্রিক অ্যানিমেটর’। সরকারি পরীক্ষায় নির্বাচিত হওয়ার পর এঁদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ডিমেনশিয়া বা স্ট্রোকে শয্যাশায়ী কোনও বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে সেবা করা থেকে শুরু করে ব্যাঙ্ক-পোস্টঅফিসের কাজে সাহায্য, এমনকী একা মানুষকে সঙ্গ দেওয়া বা বাড়ির কাজের লোকদের সামলাতেও এঁরা সমান দক্ষ। প্রয়োজনে কাউন্সেলিংও করে থাকেন এঁরা। কাজ ও বাড়ির দূরত্ব অনুযায়ী খরচের তারতম্য হয়। দিনপ্রতি ন্যূনতম খরচ ১৭০ থেকে ২০০ টাকা (আট ঘণ্টার জন্য)। ইন্দ্রাণীর কথায়, “অ্যাটেনডেন্ট নয়, বাড়ির ছেলেমেয়েদের ভূমিকাই নেন এঁরা।”
বয়স্কদের সাহায্য করতে কলকাতা পুলিশও এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে তৈরি করছে ‘প্রণাম’। সহকারী নগরপাল দেবাশিস রায় জানালেন, ষাট বছরের ঊর্ধ্বে স্থানীয় থানায় নাম নথিভুক্ত করে এর সদস্য হতে পারেন। থানা থেকে সপ্তাহে এক বার ফোন করে বা বাড়ি গিয়েও সদস্যদের খবর নেওয়া হয়। রাতবিরেতে দরকার হলে বিনামূল্যে অ্যাম্বুল্যান্স মেলে। সদস্যরা কিছু বেসরকারি হাসপাতাল ও নার্সিংহোমে ছাড় পান।

মুখ খুলতেই হবে
বৃদ্ধ বয়সে পরিজনদের কাছ থেকে অসংবেদনশীল আচরণ অনেককেই অসহায় করে দেয়। মুশকিল হল লজ্জায় মুখ খোলেন না এঁদের প্রায় কেউই। মুখ বুজে অত্যাচার সহ্য করে যান।
সুকল্যাণই শোনালেন আশি বছরের এমনই এক বৃদ্ধার কথা। ভদ্রমহিলা ছিলেন কলকাতা পুলিশের সহকারী নগরপাল। সরকারি চাকুরে ছেলে ঘরে না থাকলেই পুত্রবধূ অত্যাচার করতেন। ছেলের চাকরির কথা ভেবে বৃদ্ধা লিখিত অভিযোগ জানাতে রাজি হননি। পরিচিত পুলিশ মহলে ঘটনা জানালে তাঁরা ব্যক্তিগত ভাবে ছেলে-বৌকে ডেকে পাঠান। তাতেই কাজ হয়।
বছর খানেক আগে এক বিধবা মহিলা পড়েছিলেন অন্য এক সমস্যায়। বিদেশবাসী ছেলে দুম করে এসে মাকে পাকাপাকি ভাবে নিজের কাছে নিয়ে রাখার ইচ্ছা জানায়। ছেলেকে বিশ্বাস করে মা যাবতীয় সই-সাবুদ করে দক্ষিণ কলকাতার বিশাল বাড়ি তুলে দেন প্রোমোটারের হাতে।
নির্দিষ্ট দিনে কলকাতার পাট চুকিয়ে ছেলের সঙ্গে এয়ারপোর্টে যান বৃদ্ধা। মা’কে সেখানে বসিয়ে রেখে বিদেশে পালিয়ে যায় ছেলে। রাতভর ওই ভাবে বসে থাকার পর বৃদ্ধার কাছে ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়।
সন্তানের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতে গিয়ে অনেক বাবা-মা’ই এক পা এগিয়ে দুই পা পিছোন। কিন্তু ঘটনা হল, এ রকম ক্ষেত্রে বাবা-মা’কে এগিয়ে আসতেই হবে। অবশ্যই তা স্থানীয় থানায় জানাতে হবে। পুলিশ ‘ফ্রেন্ডলি ভিজিট’ করবে। খোঁজ রাখবে ভবিষ্যতে এমনটা যাতে না হয়। না জানালে কিন্তু সমস্যা বাড়তেই থাকবে।
দক্ষিণ কলকাতায় বয়স্কদের একটি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের তরফ থেকে সুপর্ণা মিত্র জানালেন, “এ রকম সমস্যা হলে আমরা প্রথমে কাউন্সেলিং করি, বাড়ি গিয়ে তাঁদের বোঝাই। তাতে সমস্যা না মিটলে পুলিশকে জানানোর কথা বলা হয়।”
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, ক্লাব-পাড়া-প্রতিবেশীদের সঙ্গে সু-সম্পর্ক রাখুন। ছেলেমেয়েরা জানবে বাবা-মায়ের পেছনে কেউ আছে। অসম্মানজনক কিছু করার আগে দু’বার ভাববে।
শেষ বয়সে নিজেদের অতটা অসহায় ভাবার দিন কিন্তু আর নেই। বহু বহু ‘সাপোর্টিভ সিস্টেম’ তৈরি হয়েছে। না হয় তার সাহায্যেই ঘুরে দাঁড়ান। দ্বিতীয় ইনিংসটায় আরও জমাট খেলে একদিন না হয় মাঠ ছাড়বেন। সে তো সবাই ছাড়েন। শুধু একটআধটু গুছিয়ে খেলুন। দেখবেন, ‘ব্যাট’ উঁচিয়ে গ্যালারির হাততালি কুড়োতে কুড়োতে মাঠ ছাড়তে পারবেন... পারবেনই পারবেন।

হ্যালো ডাক্তার
ডা. মৌলিমাধব ঘটক*
(চিকিৎসক ফিজিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড রিহ্যাব বিশেষজ্ঞ)
• হাঁটা-চলায় সমস্যা থাকলে নিতে হবে ব্যালেন্স ও কো-অর্ডিনেশন ট্রেনিং
• মেঝে ও বাথরুমে কোয়ার্স ম্যাট পেতে দিতে হবে। চলার সুবিধের জন্য বাথরুমের দেওয়ালে যথেষ্ট পরিমাণ রড লাগিয়ে দিতে হবে
• শুয়ে বসে থাকার প্রবণতা কমাতে নিয়মিত এক্সারসাইজ করতে হবে।
• হার্ট আর ফুসফুসের দুর্বলতা কমাতে পঞ্চাশের পরই নানা ধরনের ব্রিদিং এক্সারসাইজের সঙ্গে কার্ডিয়ো-পালমোনারি ফিটনেস ট্রেনিং শুরু করা ভাল
• আর্থ্রাইটিস থাকলে সময়মতো সঠিক ফিজিয়োথেরাপি করতে হবে, অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী
• বয়স্কদের পড়ে গিয়ে হাড় ভাঙার মতো দুর্ঘটনা প্রায়ই দেখা যায়। এ সব ক্ষেত্রে অপারেশনের পরপরই চিকিৎসকের পরামর্শ মতো মোবিলাইজেশন ফিরিয়ে আনতে হবে
• পঙ্গুত্ব আসতে পারে নানা কারণে। তার ঠিকঠাক চিকিৎসা করতে হবে
• নির্দিষ্ট সময় অন্তর খাওয়া, ঘুম, নিয়মিত চেক-আপ আপনাকে সুস্থ রাখবে
ওঁরা কারা সমস্যায় পড়লে
জেরিয়াট্রিশিয়ান: বয়স্কদের চিকিৎসক। বিশেষত ডিমেনশিয়া,
অ্যালজাইমার্স, পারকিনসন বা বয়সকালের অবসাদের
মতো সমস্যা হলে জেরিয়াট্রিশিয়ানরাই সে সব সামলান।

জেরেন্টোলজিস্ট: জেরেন্টোলজি বা বার্ধক্য বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনো করে
এঁরা বয়স্কদের সামজিক, মানসিক ও আইনি দিক নিয়ে কাজ করেন।
ডিগনিটি ফাউন্ডেশন: ৩০৬৯০৯৯৯
হেল্পেজ: ১৮০০৩৪৫১২৫৩ (টোল ফ্রি)
ক্যালকাটা মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউট
অব জেরেন্টোলজি: ২৩৭০-১৪৩৭
প্রণাম: ২৪১৯৭০৪১

* প্রতিবেদনটিতে ব্যবহৃত অনেক নামই পরিবর্তিত
কৃতজ্ঞতা স্বীকার: ডা. কৌশিক মজুমদার (জেরিয়াট্রিশিয়ান)


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.