বাঘের ডেরায় উঁকি দেওয়ার বন্দোবস্ত করতে গিয়ে কুমিরের লেজে পা দিতে চলেছে রাজ্য পর্যটন দফতর। করাত ঝুলছে ম্যানগ্রোভের উপরেও।
সুন্দরবনে ‘ইকো টুরিজ্যম’ চালু করতে চেয়ে ঝড়খালিতে ৫০ হেক্টর জমি চিহ্নিত করা হয়েছে, যেখানে জঙ্গল কেটে পর্যটন কেন্দ্র গড়া হবে। কটেজ হবে, বোটিং হবে, নামবে হেলিকপ্টার। অথচ সেখানেই একটি খাঁড়িতে গত কয়েক বছর ধরে ডিম পাড়ছে কুমির। ২০০৯ সালে আয়লার সময়েও যে ম্যানগ্রোভের আড়াল ঝড়খালির অনেকটা এলাকাকে রক্ষা করেছিল, তা উজাড় হয়ে গেল পরের সুপার সাইক্লোনে কী হবে তা নিয়ে আশঙ্কিত বিশেষজ্ঞেরা। যদিও রাজ্য সরকারের দাবি, সব দিক মাথায় রেখেই পরিকল্পনা করা হয়েছে।
যেখানে কটেজ গড়ার পরিকল্পনা, সেখানে ২৩ হেক্টর এলাকা জুড়ে রয়েছে নানা প্রজাতির ম্যানগ্রোভ। আর রয়েছে নদী থেকে বেরিয়ে আসা একটা খাঁড়ি। দেখতে একেবারে যাকে বলে বাংলার ৫। খুব নিরিবিলি সেই খাঁড়িতেই বছর পাঁচেক যাবৎ ডিম পাড়ছে কুমির। সছানাও বেরোচ্ছে। বন দফতর সূত্রের খবর, গত পাঁচ বছরে ওই খাঁড়ি থেকে অন্তত ৫০-৬০টি নানা বয়সের কুমিরছানা উদ্ধার করে পাথরপ্রতিমার ভগবতপুর কুমির প্রজনন কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে। এই বছরও অগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত পাওয়া গিয়েছে ১২টি ছানা। |
প্রজনন স্থল থেকে উদ্ধার হওয়া কুমিরছানা।— নিজস্ব চিত্র। |
দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা প্রশাসন সূত্রের খবর, খাঁড়ি ও ডাঙা-সহ গোটা জমিটিই সুন্দরবন উন্নয়ন দফতরের হাতে ছিল। মাস দুয়েক আগে পর্যটন দফতর তা অধিগ্রহণ করে। প্রশাসন সূত্রের খবর, পর্যটন কেন্দ্র গড়ার জন্য অন্তত সাত বিঘা জমিতে নানা প্রজাতির ম্যানগ্রোভও কাটা পড়বে। সেখানে পর্যটকদের জন্য তৈরি হবে কটেজ। খাঁড়ির পাড় কংক্রিটে বাঁধিয়ে কিছুটা অংশে বোটিং-এর ব্যবস্থা করা হবে। গড়া হবে হেলিপ্যাডও।
বন দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, বছর সাত আগে ওই খাঁড়িতে সুন্দরবন উন্নয়ন দফতরের উদ্যোগে মাছ চাষ শুরু হয়েছিল। খাঁড়ির পাশে দফতরের একটি কটেজও আছে। বছর দুয়েকের মধ্যে বোঝা যায়, জুনে কুমির খাঁড়িতে ঢুকে মাছ খেয়ে যাচ্ছে। মাসখানেক পর থেকে তাঁরা খাঁড়িতে নিয়মিত কুমিরের আসা-যাওয়া টের পান। মাঝে-মধ্যেই রাতে পাহারা দেওয়ার সময়ে জলে বড় মাছের মতো কিছু ভাসতে দেখা যেত। নদীতে জাল ফেলা হতেই মাস দেড়েক বয়সের আট-দশটি কুমিরছানা উঠে আসে। তখনই স্পষ্ট হয়ে যায় যে মাছ খেতে নয়, ডিম পাড়তেই নিরিবিলি জায়গা হিসেবে খাঁড়ি বেছে নিয়েছে কুমির। পরে খোঁজাখুঁজি করে খাঁড়ির আনাচে-কানাচে কুমিরের পরিত্যক্ত বাসাও পাওয়া যায়।
প্রাণিবিজ্ঞানীদের ব্যাখ্যা, স্ত্রী কুমির বা বাঘিনীর পুরুষসঙ্গীরা তাদের শাবকদের খেয়ে ফেলে। তাই মা তাদের রক্ষা করতে নিরিবিলি জায়গা খোঁজে। সাধারণত খাঁড়ি বা নদীর ধারে ম্যানগ্রোভের ঝোপে বাসা গড়ে তারা ডিম পাড়ে। প্রয়োজনে ল্যাজের ঝাপটা দিয়ে ডিমে জল দিতে থাকে। ডিম ফুটে বাচ্চা বেরোনোর ১৫ দিন পরে সেই এলাকা ছেড়ে মূল নদীতে চলে যায়। একটি কুমির সাধারণত ৬০-৭০টা ডিম পাড়ে। তার মধ্যে ৪০-৫০টা ছানা বাঁচে। অর্থাৎ, ঝড়খালির ওই ফাঁড়িতে যদি একটি কুমিরও ডিম দেয়, তাতেও বছরে গড়ে ৪৫টা কুমিরছানা পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করছে বন দফতর।
সুন্দরবনে দীর্ঘদিন গবেষণা করছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণী ও সমুদ্র বিজ্ঞান দফতরের প্রাক্তন অধ্যাপক অমলেশ চৌধুরী। তিনি বলেন, “সুন্দরবনের খাঁড়িতে মাছ চাষের কারণে বছর তিরিশ আগে এক বার কুমিরের ডিম পাড়ার উপযুক্ত নিরিবিলি বাসার অভাব হয়েছিল। তার ফলে পাথরপ্রতিমা লাগোয়া ধঞ্চি ও সপ্তমুখী নদী এলাকায় কুমিরের দেখা প্রায় মিলতই না। নানা ভাবে প্রচার চালিয়ে মাছচাষিদের সচেতন করা হয়। ওই সব এলাকায় ফের কুমিরের ডিম পাওয়া যাচ্ছে। তা সংগ্রহ করে ভগবতপুরের কেন্দ্রে নিয়ে গিয়ে ফোটানো হচ্ছে। পাঁচ বছর পরে কুমিরগুলিকে নদীতে ছাড়া হচ্ছে।” পর্যটন কেন্দ্রের জন্য কুমিরের ডিম পাড়ার জায়গা নষ্ট হলে চাকা ফের উল্টো দিকে ঘুরতে শুরু করতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞেরা।
বিপদ রয়েছে ঝড়খালির সাধারণ মানুষেরও। সুন্দরবন উন্নয়ন দফতরের এক কর্তার কথায়, “ওই এলাকায় বানি, গেঁওয়া, খলসি, ফার্ন প্রজাতির ম্যানগ্রোভ আছে। সাত বিঘা এলাকার জঙ্গল সাফ হয়ে গেলে ভবিষ্যতে বিপর্যয়ে আর কোনও প্রতিরোধের উপায় থাকবে না।” সে ক্ষেত্রে, কয়েক কোটি টাকার পর্যটন ব্যবস্থা তো এক ঝটকায় মাটিতে শুয়ে পড়বেই, গোটা এলাকারও ক্ষতি হবে বলে কর্তাদের একাংশের আশঙ্কা।
পর্যটন মন্ত্রী কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ চৌধুরী অবশ্য বলেন, “ওখানে মোট ৬৮ একর জমি নেওয়ার পরিকল্পনা আছে, যার মোটে অর্ধেকটা পর্যটনের কাজে লাগানো হবে। বাকিটা খালি পড়ে থাকবে।” তাঁর আশ্বাস, “প্রকৃতি ও প্রাণিসত্ত্বার ভারসাম্য রেখেই পর্যটন ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। কুমির-বাঘ কেউ কোনও ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। সমস্ত বিষয় মাথায় রেখেই পরিকল্পনা করা হয়েছে।” ক্ষতি এক বার হয়ে গেলে অবশ্য কুমিরকান্না কাঁদা ছাড়া কর্তাদের আর গতি থাকবে না। |