বাজারে আলুর দর অস্বাভাবিক চড়িয়া যাওয়ায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ভিন রাজ্যে আলু রফতানি নিয়ন্ত্রণের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করিয়াছিলেন। আদালত জানাইয়া দিয়াছে, তাঁহার সিদ্ধান্তটি সংবিধানসম্মত নহে। ইতিমধ্যে আলুর বাজারে জ্বর নামিয়াছে। সুতরাং রফতানি নিয়ন্ত্রণের ঘটনাপরম্পরা আপাতত ইতিহাস। কিন্তু পণ্ডিতজনে বলিয়া থাকেন, ইতিহাস হইতে শিক্ষা না লইলে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি করিতে হয়। এই ইতিহাস হইতেও শিক্ষা লইবার আছে। কেবল মুখ্যমন্ত্রী তথা তাঁহার সরকারের নহে, সাধারণ ভাবেই এই সমস্যা এবং তাহার সমাধানের উদ্যোগ হইতে কিছু মূল্যবান শিক্ষা লওয়া প্রশাসনের পক্ষে জরুরি।
প্রথম এবং প্রধান কথা ইহাই যে, ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন রাজ্য আছে বটে, তাহাদের প্রশাসনও পৃথক, কিন্তু বাজারটি অভিন্ন। সেই বাজারের একটি বিন্দু হইতে অপর কোনও বিন্দুতে পণ্য চলাচলে যাহাতে কোনও রকম বাধা না পড়ে, তাহা নিশ্চিত করাই প্রশাসনের কর্তব্য। কেন্দ্রের, রাজ্যগুলিরও। ভারতের কোনও রাজ্যই স্বয়ংসম্পূর্ণ নহে। হইবার প্রয়োজনও নাই। যে রাজ্য সর্বাধিক কুশলী ভাবে যে পণ্য উৎপাদন করিতে পারে, সেই রাজ্যটি তাহাই করিবে এবং অন্য রাজ্যগুলি সেই বিশেষ পণ্যের জন্য সেই রাজ্যটির উপর নির্ভর করিবে ইহাই অলিখিত চুক্তি। ইহাই কুশলী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়িয়া তুলিবার প্রথম ধাপ। ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশের ন্যায় অনেকগুলি রাজ্য আলুর জন্য পশ্চিমবঙ্গের মুখাপেক্ষী। তেমনই, পশ্চিমবঙ্গও ভিন রাজ্যের মাছ, পেঁয়াজ ব্যতীত অসহায়। এই পারস্পরিক নির্ভরতা যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার স্বাস্থ্য এবং সমৃদ্ধির একটি বড় শর্ত। তাহাতে বাধা পড়িলে বিপদ। সেই বাধা রাষ্ট্রের তরফে আসিলে বিপদটি গুরুতর। এই ধরনের বাধা অন্য ভাবেও কাজ করে। একটি দৃষ্টান্ত: প্রবেশ কর। এক রাজ্য হইতে অন্য রাজ্যে পণ্য চালানের উপর কর বসাইলে আপাতদৃষ্টিতে রাজস্ব বাড়ে, কিন্তু আখেরে ক্ষতিই হয়। প্রতিযোগিতার বাজার সংকুচিত হওয়ার ক্ষতি। পশ্চিমবঙ্গে এই ক্ষতি আপাতত মূর্তিমান।
আলুর বাজারের ঘটনাটিতে আর এক শিক্ষণীয় বিষয়: প্রতিযোগিতার প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করিতে নাই। সত্য, যে আড়তদাররা হিমঘরে আলু চাপিয়া রাখিয়াছিল, তাহাদের উদ্দেশ্য অসৎ। কিন্তু, তাহারা এক ভাবে বাজারের ধর্ম লঙ্ঘন করিতেছিল বলিয়া তাহার প্রতিকারে অন্য ভাবে বাজারে আঘাত করিবার অর্থ হয় না। তাহাতে বিপরীত ফলই অনিবার্য এবং তাহা হইয়াছে। জোগানের অভাবে ভিন্ রাজ্যে আলুর দাম আরও চড়িল, ফলে বাড়তি মুনাফার প্রত্যাশাও ঊর্ধ্বমুখী হইল। ফলে, আলুর দাম যত দ্রুত নামিতে পারিত, তাহা নামিল না। কপালজোরে সংকটটি নভেম্বরে ঘটিয়াছে, ফলে হিমঘরে আলু ধরিয়া রাখিবার যথেষ্ট সময় ফাটকাবাজদের হাতে ছিল না। থাকিলে, বাজারকে নিয়ন্ত্রণে আনিলে রাষ্ট্রকে আরও অনেক হস্তক্ষেপ করিতে হইত। তৃতীয়ত, যে কোনও বাজারে প্রত্যাশার একটি বড় ভূমিকা থাকে, তাহাকে অগ্রাহ্য করিলে বিপদ। একটি পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি আরম্ভ হইলে সমগোত্রীয় পণ্যগুলির দামও, কিঞ্চিৎ বিলম্বে হইলেও, চড়িতে থাকে। তাহার একটি কারণ, মানুষ মহার্ঘ পণ্যটি ছাড়িয়া অন্য পণ্যের দিকে হাত বাড়ায়, ফলে সেগুলির চাহিদা বাড়ে, দামও। কিন্তু তাহা ভিন্ন, কোনও একটি পণ্যের দাম অস্বাভাবিক চড়িয়া থাকিলে বাজারের প্রত্যাশা জন্মে যে অন্য পণ্যেরও দাম বাড়িবে। সেই প্রত্যাশা হইতে ফাটকা আরম্ভ হয়, সাময়িক ভাবে জোগান কমে। তাহাতে সার্বিক মূল্যবৃদ্ধি আরম্ভ হয়। পশ্চিমবঙ্গের বাজারেও তেমন ঘটিয়াছে। আশা, শাসকরা এই অভিজ্ঞতা হইতে শিক্ষা লইয়াছেন। ভবিষ্যতের সংকট তাঁহাদের এই পথে হাঁটাইতে পারিবে না। |