|
চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১... |
|
শিল্পরূপের মধ্যেই ফুটে উঠেছে অতীত ও বর্তমান |
সম্প্রতি স্টুডিয়ো ২১-এ অনুষ্ঠিত হল মধুজা মুখোপাধ্যায়ের একক প্রদর্শনী। লিখছেন মৃণাল ঘোষ |
সম্প্রতি ‘সাইলেন্ট ফর্মস: রিভিজিটিং সাইলেন্ট সিনেমা অব ইন্ডিয়া’ এই শিরোনামে মিডিয়া ইনস্টলেশন উপস্থাপনা করেছেন মধুজা মুখোপাধ্যায় স্টুডিয়ো ২১-এ। মধুজা চলচ্চিত্র বিষয়ের এক জন গবেষক। এ বিষয়ে বই প্রকাশ করেছেন। তথ্যচিত্র তৈরি করেছেন। ‘কার্নিভাল’ নামে তাঁর প্রথম পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছিল ১৯১১ সালে। থিয়েটার নিয়েও কাজ করেন তিনি। এখন শিক্ষকতা করছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ফিল্ম স্টাডিজ’ বিভাগে। আলোচ্য প্রদর্শনীতে চারটি কক্ষ জুড়ে রয়েছে তাঁর সাইট-স্পেসিফিক ইনস্টলেশন। অর্থাৎ গ্যালারি পরিসরের সাযুজ্যেই তিনি গড়ে তুলেছেন এগুলি। তাঁর ভাবনার মূল বিষয় ভারতবর্ষের নির্বাক চলচ্চিত্র। ১৯১৩ থেকে ১৯৩১ পর্যন্ত নির্বাক চলচ্চিত্র নিয়ে যে বহুমুখী কাজকর্ম হয়েছে তারই কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যকে ভিত্তি করে শিল্পী গড়ে তুলতে চেয়েছেন দৃশ্য-উপস্থাপনা। তথ্যকে একটি প্রস্থানবিন্দু হিসেবে ব্যবহার করে তিনি গড়ে তুলতে চেয়েছেন শিল্পরূপ। এই শিল্পরূপ প্রচলিত রীতির চিত্র-ভাস্কর্যের থেকে আলাদা। চতুর্মাত্রিক এই শিল্পরূপের ভিতর দিয়ে অতীত বর্তমানের মূল্যবোধ ও দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষিত হয়। |
|
শিল্পী: মধুজা মুখোপাধ্যায় |
আনুষঙ্গিক ‘অপর’ দিয়ে, এখানে যেটা বিংশ শতকের প্রথম দিকের নির্বাক চলচ্চিত্র, এই যে সাম্প্রতিকের উপর আলো ফেলা, এটাই ইনস্টলেশন বা স্থাপনা শিল্পের একটি বৈশিষ্ট্য। মধুজা তাঁর চলচ্চিত্র ইতিহাসের জ্ঞান ও শিল্প-নান্দনিক বোধ দিয়ে সেই কাজটিই খুব সুন্দর ভাবে করেছেন। বেশ কিছু দিন আগে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে ঊনবিংশ শতকের নবজাগরণ নিয়ে সুবিশাল বহুমাত্রিক ইনস্টলেশন করেছিলেন দিল্লির এক শিল্পী। ‘অপর’-এর সাম্প্রতিক প্রয়োগের তা ছিল এক আদর্শ দৃষ্টান্ত। মধুজার কাজ সেই বিশালতা থেকে আলাদা। কিন্তু অন্তর্দীপ্ত। অনেকের ভিতরই এরকম একটা ধারণা আছে যে নির্বাক চলচ্চিত্রের সবটাই পৌরাণিক আখ্যানমূলক। সে ধারণাটা যে ঠিক নয়, এর ভিতর দিয়ে যে নিরীক্ষণ করা যায় তৎকালীন সামাজিক বিন্যাস ও বৈশিষ্ট্যের নানা দিক, সেটাই এই রচনাগুলির মধ্য দিয়ে শিল্পী দেখাতে চেয়েছেন।
রেলগাড়ির ভাবনা নিয়ে তৈরি হয়েছে একটি ভিডিয়ো ইনস্টলেশন। আমাদের দেশে আধুনিকতার গড়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় রেলগাড়ির বিশেষ ভূমিকা আছে। ফিল্মে এমনকী সাইলেন্ট মুভিতেও রেলগাড়ি দেখা দিয়েছে বিভিন্ন ধরনের প্রতীক হয়ে। রেলের প্রতীক হিসেবে তিনি ট্রেনের দু’টি জানলার জ্যামিতিকে বেছে নিয়েছেন। গ্যালারির দেওয়ালে সংস্থাপিত হয়েছে দু’টি জানলার ফ্রেম। বাঁ পাশের ফ্রেমটির উপর প্রক্ষিপ্ত হচ্ছে একটি চলমান ফিল্মের অংশবিশেষ। তিনি বেছেছেন ১৯৩৩-এ তৈরি ‘হোয়ার্লউইন্ড’ নামে একটি ফিল্মের ট্রেলারের অংশবিশেষ। তাতে গতি আছে, কৌতুক আছে, সংঘাত ও নাটকীয়তাও আছে। জানলায় পড়ে দৃশ্যগুলো একটু ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। অতীত তেমন স্পষ্ট থাকে না বর্তমানের কাছে।
হীরা ফিল্ম কোম্পানি তৈরি করেছিল ‘জামাইবাবু’ নামে একটি নির্বাক ছবি। তাতে নায়ক-নায়িকা ছিলেন কালীপদ দাস ও রাধারানী দেবী। এই নায়ক-নায়িকার কতগুলো ফ্রেম ও সংলাপ সাজিয়ে গড়ে উঠেছে একটি দৃশ্যপ্রতিমা। গ্যলারির মাঝখানের কক্ষে একটি স্তম্ভের চার দেয়ালে সাজানো হয়েছে তা। একটি দেয়ালের বিপরীতে রয়েছে দেয়ালজোড়া আয়না। তাতে প্রতিফলিত হচ্ছে এক প্রান্তের ছবিগুলি। এই দৃশ্যমালা নিয়ে একটি ইনস্টলেশন। সেই সময়ের ফিল্ম সংস্কৃতিকে আমরা আজকের দৃষ্টিতে দেখছি। দাদাসাহেব ফালকের ‘কালীয়দমন’ ছবির বিভিন্ন স্থিরচিত্র নিয়ে তৈরি হয়েছে একটি কোলাজ। সিনেমার আদি পর্বের ইতিবৃত্তের আভাস পাওয়া যায় সেখানে। চট ঊনবিংশ ও বিংশ শতকের প্রথম পর্বের সামাজিক কর্মসংস্কৃতির একটি অঙ্গ। চট বা পাট নিয়ে অনেক তথ্যচিত্র তৈরি হয়েছে বিভিন্ন সময়। সে রকম তথ্যচিত্রের দৃশ্যমালা প্রক্ষেপ করা হয়েছে ঝুলন্ত পাটে তৈরি পর্দার উপর। প্রথাবহির্ভূত রীতির এক প্রবহমান দৃশ্য তৈরি করেছে তা। এ রকম নানা তথ্য ও দৃশ্য নিয়ে গড়ে ওঠা স্থাপনামালা দিয়ে শিল্পী ইতিহাস দিয়ে বর্তমানকে ব্যঞ্জিত করেছেন। |
|