এক ছাত্রীর মৃত্যুর মাসুল গুনে বোধোদয় হল পুরকর্তাদের।
পুরসভার কাজই হোক বা প্রোমোটারি, ইট-বালি-সুড়কি-পাথরকুচি থেকে শুরু করে সিমেন্টের বস্তা সব কিছুই রাখা হত সামনের রাস্তায়। সেই ‘ভার’ থেকে রেহাই মিলত না এক চিলতে গলি মায় জাতীয় সড়কেরও। সোমবার বারাসত পুরসভার বাদুর কাঞ্চনতলায় রাস্তার পাশে বালির স্তূপের কারণে সাইকেল নিয়ে পাশ কাটাতে না পেরে ট্রাকে পিষ্ট হয়ে মৃত্যু হয় নাজিরা খাতুন নামে এক ছাত্রীর। ওই বালি যিনি রেখেছিলেন, তাঁর বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় ক্ষুব্ধ জনতা। হামলা হয় দমকল ও পুলিশের উপরেও।
এ ভাবে রাস্তা আটকে মালপত্র ডাঁই করা রোখার কথা যাদের, সেই পুরসভাও রাস্তার ধারে আকছার ইট-বালি-পাথর ডাঁই করে রাখে। রাখে পূর্ত দফতরও। সেই স্তূপ বহু ক্ষেত্রে রাস্তার অর্ধেকটাও জুড়ে রাখে। সোমবারের দুর্ঘটনার পরে অবশেষে টনক নড়েছে। |
মঙ্গলবার বারাসত পুরসভার পক্ষ থেকে দুর্ঘটনার এলাকায় রাস্তার পাশের বালি, মালপত্র তুলে ফেলা হয়। পুরসভা ও পুলিশের তরফে অটো নিয়ে প্রচার করা হয় রাস্তার পাশে ইমারতির মালপত্র রাখা যাবে না। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে না সরালে সব মালপত্র বাজেয়াপ্ত হবে। অন্য দিকে, মধ্যমগ্রাম পুরসভার নিদান, বাড়ি তৈরি বা প্রোমোটিংয়ের ক্ষেত্রে ইমারতিদ্রব্য কোথায় রাখা হবে, তা আগে জানাতে হবে। তবেই মিলবে বাড়ি তৈরির অনুমতি। এ ব্যাপারে কড়া পুলিশও। উত্তর ২৪ পরগনার পুলিশ সুপার তন্ময় রায়চৌধুরী বলেন, ‘‘পুরসভাকে বলা হয়েছে, মালপত্র বাজেয়াপ্ত করার ক্ষেত্রেও আমরা সঙ্গে থাকব।
বস্তুত রাস্তার পাশে মালপত্র রাখার অলিখিত নিয়ম যে অনেক দিন ধরেই চলে আসছে, তা স্বীকার করে নিয়েছেন বারাসত ও মধ্যমগ্রাম, দুই পুরসভার কর্তাই। এ নিয়ে আগে কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হলেও এই প্রবণতা যে রোখা যায়নি, তা মানছেন দু’জনেই। বারাসত পুরসভার চেয়ারম্যান সুনীল মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘রাস্তায় মালপত্র রাখার উপরে আমরা আগেই নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলাম। কিন্তু এ নিয়ে এত ঝামেলা হয় যে, সে ব্যাপারে নজরদারি বা ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি।’’ মধ্যমগ্রাম পুরসভার চেয়ারম্যান রথীন ঘোষ বলেন, ‘‘এমনিতেই রাস্তার অবস্থা খারাপ। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, রাস্তার উপরে মালপত্র রেখে যাতায়াতে অসুবিধা সৃষ্টি করা হচ্ছে কি না, তার উপরে নজর রাখা হবে। কিন্তু সেই নজরদারি যে বজায় রাখা যায়নি, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।’’ তবে সোমবারের ঘটনার পরে ‘কড়া’ হয়েছে দুই পুরসভাই।
মঙ্গলবার দুপুরে দুর্ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, পুরকর্মীরাই রাস্তা থেকে বালি সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। উপস্থিত বাসিন্দারা অবশ্য দ্বিধাবিভক্ত। একদল বলছেন, ‘‘এই কাজটা যদি আগে করা হত, নাজিরাকে এমন বেঘোরে মরতে হত না।” অন্য দলের বক্তব্য, এলাকায় কাজের জন্য মালপত্র তো এলাকাতেই রাখতে দিতে হবে।
সুনীলবাবু এ দিন বলেন, ‘‘এমন মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনার পরে এ ব্যাপারে আমরা অজুহাত শুনব না। মালপত্র রাস্তায় রাখলেই বাজেয়াপ্ত করা হবে।’’ রথীনবাবু বলেন, ‘‘আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, বাড়ি তৈরি বা প্রোমোটিংয়ের অনুমতি নিতে হলে আগে মালপত্র কোথায় রাখা হবে তা জানাতে হবে।’’
ঠিক কী অবস্থায় রয়েছে বারাসত-মধ্যমগ্রামের রাস্তা? বিমানবন্দরের তিন নম্বর গেটের কাছে যশোহর রোডের উপরেই ইটের পাঁজা। মধ্যমগ্রামের পথে বিরাটিতে ইট, পাথর পড়ে রাস্তাতেই। স্থানীয় দোকানদারেরা জানালেন, এলাকার ব্যবসায়ীরাই এ ভাবে সে সব ফেলে রেখেছেন। মধ্যমগ্রাম চৌমাথার কাছে টিলার আকারে পাথরকুচির স্তূপ। স্থানীয় অটোচালকেরা জানান, সামনের একটি বহুতল নির্মাণের জন্য বহু দিন ধরে ওই পাথরকুচি ফেলে রাখা হয়েছে। যান চলাচলে ব্যাপক অসুবিধা সত্ত্বেও কেউ কিছু করতে পারছে না।
মধ্যমগ্রাম চৌমাথা থেকে বারাসতের দিকে এগোতেই রথতলা, হৃদয়পুরের কাছে রাস্তার দু’পাশ জুড়ে যাবতীয় ইমারতিদ্রব্যের স্তূপ। শুধু ব্যক্তি মালিকানার নয়, রয়েছে পুরসভা, পূর্ত দফতরের কাঁচামালও। শুধু যশোহর রোড নয়, একই হাল কৃষ্ণনগর রোড, টাকি রোড কিংবা ব্যারাকপুর রোডেও। পুরসভা বা পূর্ত দফতরের অবশ্য বক্তব্য, রাস্তা বা নিকাশির কাজের জন্যই এ ভাবে রাস্তার ধারে কাঁচামাল রাখতে হয়েছে।
আরও বেহাল অবস্থা অলি-গলিতে। কৃষ্ণনগর রোড থেকে হেলা বটতলা হয়ে বারাসত স্টেশনে ঢোকার পথ বলতে কেবল সারদা রোড। মঙ্গলবার গিয়ে দেখা গেল, একচিলতে রাস্তার অর্ধেক জুড়ে ফেলা রয়েছে মাটি। রাস্তা খুঁড়ে নিকাশির জন্য ট্যাঙ্ক তৈরি করছে পুরসভা। আর মাটির স্তূপের উপরে এক চাকা তুলে দিয়ে পার হচ্ছে স্কুলগাড়ি। পাশ কাটিয়ে চলছেন স্টেশনযাত্রী, স্কুল-কলেজের পড়ুয়ারা। স্থানীয় এক প্রবীণ বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এটুকু কাজ। চলছে তো চলছেই। কবে যে শেষ হবে কে জানে!’’ স্থানীয় কাউন্সিলর রত্না ভট্টাচার্যের অবশ্য জবাব, ‘‘সিমেন্টের ট্যাঙ্ক শক্ত হতে সময় লেগেছে। দ্রুত শেষ হবে কাজ।’’ ‘দ্রুত’ শেষ হওয়া সরকারি কাজের নামেও এ ভাবে রাস্তা বন্ধ হয়ে পড়ে থাকছে দিনের পর দিন। |