নিষ্ঠুর নভেম্বর। রাষ্ট্রপুঞ্জের নির্দেশিকা অনুযায়ী, ২৫ নভেম্বর হইতে এক পক্ষকাল বিশ্বময় নারী-নিগ্রহের প্রতিবাদ জ্ঞাপনের সময়। ভারতও প্রতিবাদ-উত্সব হইতে বাদ যায় নাই। দেশের বিভিন্ন স্থানে, বিশেষত দিল্লিতে স্বাক্ষর সংগ্রহ চলিতেছে, মিছিল হাঁটিতেছে, পথনাটক জনচেতনা বৃদ্ধির চেষ্টা করিতেছে। পরিহাস, তাহারই মধ্যে একের পর এক ভয়ানক সংবাদ ভাসিয়া আসিতেছে। কখনও কোনও প্রত্যন্ত অঞ্চলে কেহ বা কাহারা কিশোরী মেয়েকে ধর্ষণ ও খুন করিয়া চাষজমিতে ফেলিয়া গিয়াছে, কখনও মহানগরের বুকে নামজাদা প্রচারমাধ্যম-তারকার বিরুদ্ধে তরুণী সহকর্মিণীকে নির্যাতন করিয়া মুখবন্ধের হুমকি দেওয়ার অভিযোগ উঠিতেছে। নারীর উপর নির্যাতনের বহমানতা নূতন নহে, তবু সংবাদ-শিরোনামের মিছিল স্বভাবতই প্রশ্ন উঠায়: আর কত প্রতিবাদ-পথ পার হইলে তবে এক পা অগ্রসর হওয়া যায়!
তবে অপরাধ চিরকালীন বলিয়াই হয়তো শিরোনামগুলির একটি মাহাত্ম্যও রহিয়াছে। শিরোনামই বুঝাইয়া দেয়, সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে চোরা-ফাঁদের নাছোড় অস্তিত্ব এ দেশের দুর্ভাগ্য ঠিকই, কিন্তু দুর্ভাগ্যের বহর জানিবার যে সৌভাগ্যটুকু আজ হইতেছে, তাহাও কম কথা নয়। যে খ্যাতনামা প্রচারমাধ্যমে এত দিন দুর্নীতি লইয়া ধরণী উথালাপাথাল হইত, তাহারই এক শীর্ষকর্তা তরুণ তেজপালের বিরুদ্ধে যৌননিগ্রহের অভিযোগ: সর্ষের ভূত অনেক গভীরে প্রোথিত। এ মাসেরই গোড়ার দিকে কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা সি বি আই-এর শীর্ষ পুলিশ কর্তা রঞ্জিত সিংহের মুখে প্রকাশ্য সভায় সকৌতুক মন্তব্য: কথায় বলে ধর্ষণের মতো কাজ বন্ধ করিতে না পারিলে অন্তত তাহা ‘এনজয়’ করা উচিত। তাঁহার রসবোধ লইয়া মন্তব্যের প্রয়োজন নাই, তবে কেন যে যাবতীয় প্রাতিষ্ঠানিক সুরক্ষা-ব্যবস্থা কিছু দূর অগ্রসর হইয়াই তাসের ঘরের মতো হুড়মুড়াইয়া পড়ে, একা রঞ্জিত সিংহই তাহার জলজ্যান্ত প্রমাণ হইয়া রহিলেন। নিয়তির পরিহাস বলিতে হইবে যে এই মাসেই অভিযোগ শোনা গেল, সুপ্রিম কোর্টে এক অবসরপ্রাপ্ত বিচারক এক আইন-ছাত্রীকে যৌন নির্যাতন করিতে গিয়াছিলেন, ছাত্রীটি পলাইয়া বাঁচিয়াছেন। রাষ্ট্র ও সমাজের উচ্চ স্তরেও দিকে দিকে দিকপালরা এমন ব্যবহার করিতে পারেন, যে ব্যবহারের বিরুদ্ধে তাঁহাদের নাকি সতত সংগ্রাম করিবার কথা ছিল!
পুরুষতান্ত্রিকতার ফাঁদ ইত্যাদি শব্দবন্ধ অতি পুরাতন। যে কোনও নাগরিক এমন কাজ বা মন্তব্য করিলে যে তাঁহাকে তত্ক্ষণাত্ রাষ্ট্রের আইনের চোখে অপরাধী সাব্যস্ত করা দরকার, শাস্তিবিধান দরকার, তাহাও সর্বজ্ঞাত। প্রশ্ন: রাষ্ট্র জরুরি কাজগুলি করিবে কি না, প্রতিবাদীরা রাষ্ট্রকে দিয়া তাহা করাইতে পারিবেন কি না। প্রতিবাদে আস্থা হারাইবার কারণ নাই। চিরকালীন এই ব্যাধি যে আজ ক্রমাগত প্রকাশিত হইতে পারিতেছে, তরুণবয়সি সাংবাদিক বা ছাত্রী যে আপন লাঞ্ছনার কথা প্রকাশ করিতে পারিতেছেন, ক্ষমতাসীনদের মুখোশ খুলিয়া দিতে পারিতেছেন, ইহাই তো প্রতিবাদের সংস্কৃতির মূল্য বুঝাইয়া দেয়। এই সংস্কৃতিও কিন্তু নূতন নয়। পশ্চিমি প্রচারমাধ্যম যতই দিল্লিকে ধর্ষণ-রাজধানী কিংবা ভারতকে বিপজ্জনক বলিয়া প্রচার করুক, ভারতের মতো এমন বিপুলসংখ্যক নারী প্রতিবাদীও বিশ্বের কম দেশে আছে। যত নারী এ দেশে শহরে গ্রামে প্রত্যহ কাজ করিতে বাহির হন, অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখিয়া দাঁড়ান, তাহার পরিসংখ্যান দরকার। আমানা ফনতানেলা-খানের গবেষণাগ্রন্থ জানাইয়াছে, বুন্দেলখণ্ডে ‘গোলাপি শাড়ির আন্দোলন’ কী ভাবে স্থানীয় নারীনিগ্রহ আটকাইয়াছে। এমন আরও তথ্য-সংবাদ প্রয়োজন। আশার কথা, লিঙ্গ-হিংসার বিরুদ্ধে এমন লাগাতার জনসংগঠনের প্রয়াস ২০১৩ সালের আগে এ দেশে দেখা যায় নাই। বছরটি ব্যতিক্রমী। |