বরফের ওপর হনুমানের ল্যাজ |
হাড় হিম করা মৃত্যুভয়। তবু ভয়ঙ্কর সুন্দর। উত্তর মেরুতে বাংলা ছবির
রোমাঞ্চকর শ্যুটিংয়ের স্মৃতি। ফিরে দেখলেন ইন্দ্রনীল রায়। |
আ..ই..স..ল্যা..ন্ড!!!
বলছেন কী প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়? ওখানে হবে বাংলা ছবির শ্যুটিং!
২০১২-র অগস্ট। তখনও দক্ষিণ আফ্রিকা কী মিশর পৌঁছয়নি বাংলা ছবি। বিদেশে শ্যুটিং মানে প্রধানত গানের সিকোয়েন্স। কিন্তু সব চেয়ে এক্সোটিক লোকেশন হিসেবে সারা জীবন বাংলা ছবির ইতিহাসে থেকে যাবে ‘হনুমান.কম’।
আইসল্যান্ডে শ্যুটিং কভার করতে গিয়ে অনেক অভিজ্ঞতাই হয়েছিল। কিছু আগেই লেখা হয়েছে। কিন্তু অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারে এত কিছু রয়েছে যা আজও লেখা হয়নি। বরফের দেশের কিছু বিশেষ মুহূর্ত আনন্দplus-য়ের পাতায়। |
লজ্জা করে না এখানে শ্যুটিং করছেন |
আইসল্যান্ডের রাজধানী রেইয়াভিকের সব চেয়ে ব্যস্ত অঞ্চলে শ্যুটিং সে দিন। সব চেয়ে ব্যস্ত মানে আবার ধর্মতলা ভাববেন না। সব চেয়ে ব্যস্ত মানে এক নজরে দশ জন মানুষকে দেখা যাচ্ছে।
সারা দিন ধরে বৃষ্টি হয় এমনিতেই। আর বিকেল চারটের সময় তো পুরো অন্ধকার!
এমন এক মুহূর্তে শ্যুটিং শুরু হল। শ্যুটিং শুরু হওয়ার পাঁচ মিনিটের মধ্যে দুই মদ্যপ এসে অকথ্য ভাষায় ‘হনুমান.কম’-য়ের জার্মান ক্রু-কে হঠাৎ মনের সুখে গালাগালি দিতে শুরু করে দিল। তাদের বক্তব্য, তাদের দেশে মানুষ যখন কাজ পাচ্ছে না, তখন জার্মানরা এসে এখানে কেন কাজ করবে!
গলার আওয়াজ বাড়তে বাড়তে তখন প্রায় মারামারির অবস্থা। এটা কোনও দিন এর আগে লিখিনি। কিন্তু পরিস্থিতি সামলাতে গিয়ে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়কেও অকথ্য গালাগালি শুনতে হল ওই দুই ভদ্রলোকের কাছ থেকে। এমনকী তারা জোরে ধাক্কা মেরে সরিয়েও দিল প্রসেনজিৎকে।
চারিদিক অন্ধকার, প্রসেনজিৎও শকড্। সে দিনের মতো শ্যুটিং প্যাক আপ করে দেওয়া হলেও এই ঘটনা সম্ভবত এই ছবির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা কারও পক্ষেই ভোলা সম্ভব নয়। |
এক নৌকায় সচিন ও প্রসেনজিৎ |
তবে আইসল্যান্ড কিন্তু অদ্ভুত জায়গা। অবসরের কিছু দিন আগে সচিন তেন্ডুলকরকে জিজ্ঞেস করা হয় তাঁর সব চেয়ে প্রিয় দেশ কোনগুলি। তার উত্তরে সচিন আইসল্যান্ডের নাম বলেছিলেন। তবে তার একটা কারণও রয়েছে। সচিন বলেছিলেন এটা এমন একটা দেশ, যেখানে ওঁকে ক্রেডিট কার্ড পকেট থেকে বের করতেই হয়নি কারণ ওখানে কিছুই পাওয়া যায় না।
কথাটা একেবারেই ভুল বলেননি সচিন।
শ্যুটিংয়ের ফাঁকে সে দিন সবাইকে নিয়ে শপিংয়ে বেরিয়েছেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। উপলক্ষ সবার জন্য কিছু কেনাকাটা করা। দোকানের নামটিও দেশের ভৌগোলিক লোকেশনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ৬৬ ডিগ্রি নর্থ। |
|
প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়: তাপমাত্রা তখন দু’ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড |
কিন্তু এ কী? দোকানে তো কিছু আগ্নেয়গিরির লাভা শুকিয়ে পাথর আর জ্যাকেট ছাড়া কিছুই পাওয়া যায় না! দোকানে দাঁড়িয়ে তখন নিজেই হাসছেন প্রসেনজিৎ। তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী সুভাষ এ দিকে বলছে, “কী দেশ! এত শখ করে দাদা সবার জন্য জিনিস কিনতে এল। কিন্তু কিছু পাওয়াই যায় না।”
তবে হ্যাঁ, ওখানে জিনিসপত্র পাওয়া না গেলেও ওয়াইন শপ-য়ের কিন্তু ছড়াছড়ি।
এবং স্পষ্ট মনে আছে প্রসেনজিৎ একদিন ঠিক করলেন ইউনিটের সবার জন্য পার্টি দেবেন। শুধু চার বোতল পানীয়র দামই পড়ল পঞ্চান্ন হাজার টাকা। কলকাতায় ওই একই জিনিসের দাম - তিন হাজার টাকার একটু বেশি। |
ওই ঠান্ডায় কিডনি খারাপ মানেই মৃত্যু |
এমনিতেই এয়ারপোর্টে নেমে সবাইকে বেশ মোটা মোটা লাগছিল। তা গৌরব পান্ডেই হোক কী ছবির এক্সিকিউটিভ প্রোডিউসর শিবাশিস শেঠই হোক। তা হলে কি এখানে এসে ব্যাপক খাওয়াদাওয়া করছে ইউনিট? পরে বুঝলাম এই মোটা হওয়ার পিছনে খাবার নেই, রয়েছে ‘এক্সট্রা প্যাডিং’।
মানে?
আইসল্যান্ডে দিনের তাপমাত্রা ২ থেকে ৩ ডিগ্রি থাকে। স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কথা বলে ‘হনুমান.কম’-য়ের ক্রু জানতে পেরেছিল ওই ঠান্ডায় সব চেয়ে আগে নাকি কিডনি অ্যাফেক্ট করে। এবং বেশিক্ষণ বাইরে থাকলে ওই ঠান্ডায় কিডনি ফাংশন বন্ধ হয়ে মৃত্যুও হয়েছে বহু আইসল্যান্ডবাসীর।
সে জন্যই পিঠের দু’দিকে হট প্যাডিং লাগিয়ে ঘুরছে ছবির সব ক্রু।
“গৌরব তো একসঙ্গে তিন-চারটে প্যাডিং ব্যবহার করত। আমরা প্রায় জিরো ডিগ্রি-তে শ্যুটিং করেছি। ওই প্যাডিং না হলে মরে যাবে মানুষ,” একদিন শ্যুটিং থেকে ফিরতে ফিরতে গাড়িতে বসে গল্পটা বলছিলেন প্রসেনজিৎ।
আইসল্যান্ডের শ্যুটিংয়ে দায়িত্বে থাকা শিবাশিস-এর কাছেও আইসল্যান্ডের শ্যুটিং ছিল সাঙ্ঘাতিক চ্যালেঞ্জিং। “একে ঠান্ডা, তার পর কিছুই পাওয়া যায় না দেশটায়। কী কষ্ট করে শ্যুটিং করেছি, আমরাই জানি,” বলছিলেন শিবাশিস। |
খাবার বলতে বাসি সেদ্ধ মাছের স্যুপ |
সারা দিন শ্যুটিং তো হল, এত খাটনির পর যদি ভাবেন এলাহি খাওয়াদাওয়া হচ্ছে, তা হলে কিন্তু একেবারেই ভুল ভাবছেন। এমনিতেই আইসল্যান্ডে বিশেষ কিছুই পাওয়া যায় না। যে খাবার আসুক, তা আসে মেনল্যান্ড ইউরোপ থেকে।
তাই শ্যুটিং থেকে ফিরে শুধু স্যুপ আর পাউরুটি ছাড়া কিছুই খাওয়া হয়নি পুরো ছবির ক্রুদের। এবং যদি ভাবেন স্যুপ খুব সুস্বাদু, তা হলে কিন্তু ভুল বুঝবেন কারণ স্যুপটা বানানো হয়েছে তো বাসি মাছ সেদ্ধ করে।
“আমি তো পুরো শ্যুটিংয়ে শুধু পাউরুটি খেয়েই কাটিয়েছি। ওই পাউরুটি আর জ্যাম,” কলকাতায় ফিরে বলছিলেন প্রসেনজিৎ।
বাকি ইউনিটের অবস্থা আরও খারাপ। তাঁরা ডিনার টেবিলে খেয়ে তো নিচ্ছেন খাবার। তার পর যে যার ঘরে ফিরে সারা রাত জেলুসিল। |
এত টেনশন আমার বহু দিন হয়নি |
এ রকম বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার মধ্যে নমিত বাজোরিয়া প্রযোজিত ‘হনুমান.কম’য়ের শ্যুটিংয়ের সব চেয়ে মনে রাখার মতো ঘটনা কিন্তু এমন একটা জায়গায়, যেটা দর্শকরা স্ক্রিনে দেখলে অবশ্যই চমকে যাবেন । যাঁরা ওখানে শ্যুটিং করেছেন তাঁরাও বেশি হতচকিত হবেন সেই অভিজ্ঞতাগুলো ‘রি-লাইভ’ করে।
রেইয়াভিক থেকে প্রায় দু’ঘণ্টা দূরে ওই জায়গার নাম ‘এন্ড অব দ্য ওয়ার্ল্ড’। সত্যি সত্যিই পৃথিবীর শেষ প্রান্ত।
পুরো ইউনিট ওখানে শ্যুটিংয়ে পৌঁছনোর পরেই ঘটল প্রথম দুর্ঘটনা। এসইউভি-র দরজা খুলতেই সাঙ্ঘাতিক হাওয়ায় দরজা গেল ভেঙে।
“এত হাওয়ায় শ্যুটিং করব কী করে?” ফিসফিস করে তখন জার্মান ক্রু-কে জিজ্ঞেস করছেন পরিচালক ।
সবাই গাড়ি থেকে নেমে আসার পর শুরু হল আরও বিপদ। এত হাওয়ায় কেউ দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না যে।
অগত্যা পুরো পঞ্চাশ জনের ক্রু হামাগুড়ি দিতে দিতে পৌঁছল শ্যুটিং লোকেশনে। লোকেশন বলে লোকেশন! সমুদ্রের ধারে একটি পাহাড়ের চুড়ো সেটা। কেউ পড়ে গেলে অন্তত ১৫০ ফুট নীচে পাথরের ওপর গিয়ে পড়বে। এত হাওয়াতে কেউ কারও কথা শুনতে পাচ্ছে না। আর ঠান্ডা? সেটার কথা নয় না-ই বললাম।
গত সপ্তাহে আড্ডা মারতে মারতে প্রসেনজিৎ বলছিলেন, এত ভয়াবহ দৃশ্যের শ্যুটিং আগে কখনও করেননি।
“যে কোনও সময় দুর্ঘটনা হতে পারত। এত হাওয়া যে কেউ কেউ উড়ে যেতে পারত। আমি সত্যি টেনশনে ছিলাম। বহু দিন এত টেনশন আমার হয়নি, যা সে দিন হয়েছিল,” বলছিলেন তিনি।এ সব অভিজ্ঞতা যে ছবির সঙ্গে রয়েছে, তার ভাগ্যবিচার হবে ৬ ডিসেম্বর।
কিন্তু এটা নিশ্চিন্ত ভাবেই বলা যায়, বাংলা ছবির বিদেশে শ্যুটিং যত দিন হবে, তত দিনই আইসল্যান্ডকে উপেক্ষা করে কোনও শ্যুটিংয়ের গল্পই সম্পূর্ণ হবে না। |
|