কোঁচকানো চামড়া, তোবড়ানো গাল। বয়সের ভারে চোখ কোটরে ঢুকে গিয়েছে। ফোকলা দাঁতে হাসি নিয়ে নাংলা বিলের শেষ প্রান্তে লাল ফিতে ছুঁতে চাইছেন বৃদ্ধা। ওই ফিতেই তো যুদ্ধ জয়ের সীমানা। দাঁড় টানতে টানতে কখন যে পরনের শাড়ি ভিজে চুপচুপে হয়ে গিয়েছে, তাঁর খেয়াল নেই। শুধু একটাই লক্ষ্য, দাঁড় বেয়ে নৌকা নিয়ে যেতে হবে শেষ সীমানায়। জিততে হবে বাইচ প্রতিযোগিতা।
সম্প্রতি উত্তর ২৪ পরগনার হাবরার কাশীপুরে হল মহিলাদের বাইচ প্রতিযোগিতা। সদ্য বিবাহিতা থেকে ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধা, কোমরে আঁচল বেঁধে নৌকা চালালেন সেখানে। ফেলে আসা দিনগুলোর স্মৃতি রোমন্থন করলেন বৃদ্ধারা। দেশভাগের কথা, ও পার বাংলার নৌকা বাইচের কথা। ছোটরা শুনলেন তাঁদের গল্প। দেশকালের স্মৃতি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চারিয়ে গেল একটা বাইচ প্রতিযোগিতাকে কেন্দ্র করে।
বাইচ প্রতিযোগিতায় অংশ নিলেন যারা, তাদের পুরনো প্রজন্মের বেশিরভাগই বাংলাদেশে জন্মেছেন। ছেলেবেলা কেটেছে সেখানে। তার পর দেশ ভাগ, বিয়ে হয়ে এ পারে চলে আসা। বিলের জলে নৌ বাইচ, নৌকা করে মাছ ধরা, গাছে উঠে লুকোচুরি সবই তখন স্মৃতি। সেই স্মৃতি হয়তো ঝাপসা হয়েই যেত। কিন্তু বছরে এক বার নাংলার বিলে বাইচ প্রতিযোগিতাটা মনে করিয়ে দেয় পুরনো সেই দিনের কথা। এক দিনের জন্য ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধা খুঁজে পান ফেলে আসা দিন, শৈশব। আর তারপরেই শক্ত হাতে হাল ধরে, কখন যে সেই বৃদ্ধা হয়ে যান পুরনো সেই দস্যি মেয়ে, নিজেই বুঝতে পারেন না। |
ষাটটা হেমন্ত পেরিয়েছেন কাশীপুরের হাসি মণ্ডল। ছোটবেলা কেটেছে বাংলাদেশের জলিপাড়ায়। গাছের ডালে লুকোচুরি থেকে শুরু করে নদীতে ছোঁয়াছুয়ি, হা-ডুডু খেলা, গাদি খেলা এ সব জীবন থেকে হারিয়ে গিয়েছে জীবন থেকে। জীবনের প্রায় প্রান্তে এসে বৃদ্ধার মনে পড়ে যায়, ছেলেবেলার কথা। বলেন, “বাংলাদেশে যখন ছিলাম, বাড়ির পাশে ছোট্ট একটা বিল ছিল। নৌকা নিয়ে কত মাছ ধরেছি। সাত বছর বয়স থেকে নদীতে ঘুরে ঘুরে বেড়াতাম। এখন আর সেই সুযোগ কই! এখনকার মেয়েরা তো নৌকা চেনেই না!” তবে বছরের ওই একটা দিন নৌকা বাইচের সময়ে মনে পড়ে যায়, ছেলেবেলার স্মৃতি। অপেক্ষা করে থাকি। তার পর দিনটা কেটে গেলে ফের অপেক্ষা। পঁয়ষট্টি বছরের বৃদ্ধা রেখা বিশ্বাস বলেন, “বাংলাদেশের খলিতপুরে বড় হয়েছি। ওখানে লক্ষ্মী পুজো বা কালী পুজোয় নৌ বাইচ প্রতিযোগিতা হত। এখানে তা আর হয় কই!! খলিতপুরে দশ বছর বয়স থেকে নৌ বাইচে অংশগ্রহণ করে আসছি। এখানে তো বছরে এক বার হয়। সেই দিনটা এক বারের জন্যও হাতছাড়া করতে চাই না। এই বয়সে জল ভেঙে নৌকা বাইতে কষ্ট হয়। কিন্তু খেলার আনন্দে তা আর কষ্ট বলে মনে হয় না।”
প্রবীণরা যদি এই প্রতিযোগিতায় মাতেন স্মৃতিটুকু জিইয়ে রাখতে, নবীনরা এই খেলায় মাতেন দারিদ্র ভুলতে। স্থানীয় আমপাড়া, ঘোজের মাঠ, টুনিঘাটা, কাশীপুর অঞ্চলের মহিলারা এই বাইচ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন। কারওরই পরিবারের আর্থিক অবস্থা বিশেষ কিছু না। ঘোজের মাঠের এক জন বলেন, “আমার স্বামী পরের জমিতে কাজ করেন। সংসার সামলে এই দিনটাতেই তো একটু আনন্দ করার সুযোগ পাই। তাই এই দিনটা হাতছাড়া করতে চাই না।” দীর্ঘ বারো বছর ধরে এ পার বাংলার বাইচে অংশগ্রহণ করছেন কাশীপুরের মালতি বিশ্বাস, ভানুমতী বিশ্বাস, শেফালি বিশ্বাস, টুলু বিশ্বাসেরা। টুলুর কথায়, “এই দিনটায় সংসার, দারিদ্র সব যেন কোথায় চলে যায়। মাত্র একটা দিনে মন ভরে না। আর কয়েকটা দিন যদি এমন প্রতিযোগিতা হয়, তবে দারিদ্র ভুলে থাকতে পারি!” ভানুমতী বলেন, “আমার জা আমাকে নৌকা বাইচ শিখিয়েছিলেন। তার পর থেকে একটা বছরও বাদ দিইনি।”
নাংলার বিলে বাইচ প্রতিযোগিতায় মেয়েদের উৎসাহ দিচ্ছেন নারী, পুরুষ নির্বিশেষে এলাকার বাসিন্দারাও। তবে মেয়েদের আগ্রহ স্বাভাবিকভাবেই বেশি ছিল। জলে না নামলেও উৎসাহ দেওয়ার জন্য পাড়ে ভিড় করে দাঁড়িয়েছিলেন ওঁরা। তাঁদেরই একজন, কাশীপুরের সুমনা বিশ্বাস বললেন, “সুযোগ পেলে জলে নামব। বয়স্করা নৌবাইচ খেলছেন, আমিও পারব।”
কিন্তু প্রায় সকলেরই আশঙ্কা, ইতিমধ্যেই নাংলার বিল মজতে শুরু করেছে। দ্রুত সংস্কার না করলে অচিরেই হয়তো বন্ধ হয়ে যাবে বাইচ প্রতিযোগিতা। স্থানীয় বিধায়ক জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বলেন, বিলের সংস্কারের জন্য পরিকল্পনা করা হয়েছে। কাজ শুরু হবে। বাইচের মতো খেলা টিকিয়ে রাখতে চেষ্টা করব। |