সিবিআই-এর অধিকর্তা রঞ্জিত সিংহ সম্প্রতি একটি বেফাঁস মন্তব্য করিয়া বিপাকে পড়িয়াছেন। তিনি বলিয়াছেন, যদি বেটিং বন্ধ করা না যায়, তাহা হইলে তাহাকে আইনি স্বীকৃতি দেওয়া হোক, ঠিক যেমন বলা হইয়া থাকে, ধর্ষণ যদি আটকানো না যায়, তবে তাহা উপভোগ করাই ভাল। এই মন্তব্য স্বাভাবিক ভাবেই নিন্দার ঝড় তুলিয়াছে। সিংহমহাশয় পরে অবশ্য ক্ষমাপ্রার্থনার সুরে বলিয়াছেন, তিনি ধর্ষণকে ছোট করিয়া দেখার বাসনায় ওই মন্তব্য করেন নাই, প্রচলিত বাগ্ধারা ব্যবহার করিয়া উদাহরণ দিতে চাহিয়াছিলেন মাত্র। কিন্তু প্রশ্ন হইল, এমন উদাহরণ, উদাহরণ হিসাবেও অত্যন্ত আপত্তিকর নহে কি? বিশেষত গুরুত্বপূর্ণ এক জন আধিকারিকের পক্ষে? এমন পদে যিনি আসীন, কথা বলিবার সময় তাঁহার কি অনেক বেশি সংযত হওয়া উচিত ছিল না? সংযমের অভ্যাস করেননি বলিয়াই কি তাঁহাকে এমন বিপাকে পড়িতে হইল না?
সংযম অতি উপকারী বস্তু। কেবল বাক্যের সংযম নহে। আচরণের সংযম। চিন্তার সংযম। তাহা চরিত্র গড়িবার একটি মূল উপাদানও বটে। সাধারণ মানুষ দৈনন্দিন জীবনে নিজ অজান্তেই অনেক সংযম অভ্যাস করিয়া থাকে। বড় হইবার প্রক্রিয়ার মধ্যেই তাহা ঢুকিয়া যায়। কিন্তু নিত্যনৈমিত্তিক জীবনের সংযম এক জিনিস, আর চিন্তিত আত্মনিয়ন্ত্রণ অন্য ব্যাপার। তাহা সচেতন ভাবে অভ্যাস করিতে হয়। কঠোর অভ্যাস। তাহা মধুমেহ হইলে শর্করা হইতে দূরে থাকিবার অভ্যাস নহে, নিজেকে নিয়ত নিরীক্ষণের অভ্যাস। নিজের চিন্তাকে নিরপেক্ষ ভাবে বিশ্লেষণ করিবার অভ্যাস। তাহার সনিষ্ঠ অনুশীলনেই চিন্তা সুচিন্তার পর্যায়ে উন্নীত হইতে পারে। এবং সুচিন্তিত মতামত মস্তিষ্কে গ্রথিত হইলে কথা বলিবার মুহূর্তে পুনরায় ভাবিয়া বলিবার প্রয়োজন হয় না। চিন্তার সংযম অনৈতিক অবস্থানকে আপনিই নৈতিকতার পাবকে পুড়াইয়া শুদ্ধ করিয়া দেয়।
প্রশ্ন উঠিতে পারে, কোনটি নৈতিক, কোনটি অনৈতিক, তাহা কে স্থির করিয়া দিবে? নৈতিকতার কিছু মৌলিক অবস্থান সময়, স্থান, কাল পাত্র নিরপেক্ষ। কিন্তু বাস্তব জীবনের প্রেক্ষিতে নৈতিকতার ধারণা অনেকাংশেই সময়-নির্ভর, সমাজ-নির্ভর। যেমন, পূর্বেও ধর্ষণ অপরাধ ছিল, এখনও রহিয়াছে। কিন্তু সমাজের চিন্তায় পূর্বে ধর্ষণের সঙ্গে মূলত জড়িত থাকিত নারীর ‘ইজ্জত’-এর ধারণা, যাহা হরণ করা হইলে তাহাকে পরবর্তী জীবনে অসতীর অসম্মান লইয়া বাঁচিতে হয়। ধর্ষণকে আটকাইতে না পারিলে তাহাকে আনন্দের উপাদান বলিয়া গ্রহণ করা যাইতে পারে— এমন একটি কথা সমাজ আদৌ ভাবিতে পারিত, তাহার কারণ সেই সমাজ মনে করিত, ধর্ষণ মূলত একটি যৌনক্রিয়া। সময় বদলাইয়াছে। সমাজ বদলাইয়াছে। চিন্তা বদলাইয়াছে। আজ ধর্ষণকে প্রথমত এবং প্রধানত হিংসা বলিয়া, ভয়ানক হিংস্রতা বলিয়াই গণ্য করা হয়। নারীর শরীরের, মনের, সত্তার অধিকার লঙ্ঘনের হিংস্রতা। সমাজচিন্তার এই বদলকে, তাহার পরিবর্তিত নৈতিকতার অবস্থানকে সম্মান করিতে শিখিতে হইবে। বিশেষ করিয়া যাঁহারা সমাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় আছেন, তাঁহাদের এই বিষয়ে অতিসচেতন থাকিতে হইবে। সেই পরিবর্তনকে মযার্দা দিতে হইলে সংযম বিশেষ আবশ্যক। আবশ্যক কথায়, আচরণে ও চিন্তায় নিরন্তর আত্মনিয়ন্ত্রণ। এই আত্মনিয়ন্ত্রণ উপর হইতে চাপাইয়া দেওয়া যায় না, অন্তর হইতে উৎসারিত হইলে তবেই তাহা সত্য হইয়া উঠে। তাহাতে মানুষের আত্মমর্যাদা বাড়ে। |