ছাত্র রাজনীতির সহিত ওতপ্রোত ভাবে যুক্ত আছেন বা ছিলেন, এমন অনেক নেতা ‘ছাত্রজীবন’ ও ‘শৃঙ্খলা’ শব্দ দুইটি পাশাপাশি দেখিলেই চটিয়া লাল হইয়া যান। শৃঙ্খলাই যেন ছাত্র রাজনীতির সর্বাপেক্ষা বড় শত্রু কিংবা ছাত্রসমাজের পুষ্পেপত্রে বিকশিত হইবার পথে প্রধান বাধা। তাই কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শৃঙ্খলাবিধি প্রবর্তনের উদ্যোগমাত্র হইলেই ইঁহারা বিপ্লবী দিব্যদৃষ্টিতে গণতন্ত্রের উপর পুঁজিবাদী আগ্রাসনের খড়্গ নামিয়া আসিতে দেখেন। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে নূতন বিধি-নির্মাণের সংবাদ আসিতেই তেমন প্রতিক্রিয়া দৃশ্যমান হইতেছে। অথচ যে কোনও প্রতিষ্ঠানের তরফেই সদস্যদের নিকট কিছু আচরণধারার প্রত্যাশা স্বাভাবিক, তাহা মান্য হইতে না দেখিলে শৃঙ্খলা-বিধি প্রয়োগ করিবার চেষ্টাও স্বাভাবিক। বিদ্যার্থীদের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক বিধি প্রবর্তনের প্রয়াসকে গণতন্ত্রের বিরোধিতা বলা হইবে কেন? গণতন্ত্রের অর্থ যখন তখন যেখানে সেখানে যাহা ইচ্ছা করিবার অবাধ অনুমতিপত্র নহে। সকলের সুবিধা-অসুবিধা বিচার করিয়া একটি সুস্থ স্বাভাবিক রীতিতে চলাফেরা করার ইচ্ছাও গণতান্ত্রিক ইচ্ছা। কলেজ চত্বরে বসিয়া মাদকসেবন না করিবার বিধি বা সন্ধ্যাকালে কলেজ চত্বর ফাঁকা করিয়া দিবার বিধানে আপত্তির বিশেষ কারণ নাই, সকলের গণতান্ত্রিক অধিকার পূর্ণ করিয়াই কলেজ প্রাঙ্গণকে নিরাপদ করিবার দায়টি কলেজ কর্তৃপক্ষকেই পূর্ণ করিতে হয়, কেননা অন্যতর বিপত্তি কিছু ঘটিয়া গেলে সেই কর্তৃপক্ষকেই ‘গণতান্ত্রিক নিরাপত্তা’ রক্ষা না করিবার অভিযোগে অভিযুক্ত হইতে হয়।
বিশ্বের বহু খ্যাতনামা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই এমন শৃঙ্খলাবিধি রহিয়াছে, তাহাতে সেই প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের নৈতিক বা রাজনৈতিক চরিত্র পঙ্গু হইয়া যায় নাই। বরং তাঁহারা শিক্ষা পাইয়াছেন যে প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলার পথ ধরিয়াই সামাজিক শৃঙ্খলা বিকশিত হয়, যে সামাজিক শৃঙ্খলা যূথজীবনের জন্য জরুরি। যূথজীবনের মাত্রাগুলি মানিয়া চলিতে চলিতেও ব্যক্তিস্বাধীনতা বজায় রাখা যায়। কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে বসিয়া কতগুলি কাজ না করিলেও অন্যত্র অন্য সময়ে নিজেদের জীবন লইয়া যদৃচ্ছ পদক্ষেপ লইতে কেহ বাধা দেয় না। রাজনীতিই হউক, সৃষ্টি-শিল্পই হউক, নৈরাজ্যই হউক: কোনও প্রাতিষ্ঠানিক ফাঁসে কেহ কোনও দিন উড়ন্ত পাখায় শিকল পরাইতে পারে নাই। কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চত্বরে কিছু মৌলিক আচরণবিধি মানিয়া চলিতে হইবে, ইহা শিক্ষারই একটি অঙ্গ। ছাত্রছাত্রীদের এই শিক্ষা দান করা জরুরি যে, বড় হইয়া উঠিলে মৌলিক অধিকার ভোগ করিবার সঙ্গে কিছু মৌলিক দায়িত্ব পূরণ করা আবশ্যক। এই দায়িত্ব পালনের কাজটি কাহারও একক স্বার্থভিত্তিক নহে, বরং যৌথস্বার্থভিত্তিক। যে সমাজে নৈরাজ্য, দুর্নীতি, নিরাপত্তাহীনতা আকাশছোঁয়া, ছাত্র রাজনীতির নামে ব্যাপক গুণ্ডামি, এমনকী হানাহানি প্রাত্যহিক বাস্তব, সেখানে এই দায়িত্ব পালনের কাজটি আরও বেশি গুরুতর।
যে কোনও বিধিবিধানের ক্ষেত্রেই প্রেক্ষিত বিচার জরুরি। সেই প্রেক্ষিতের বোধ বলিয়া দেয় যে, ২০১৩ সালের কলিকাতা শহরে যদি একটি নবজাত উৎকর্ষকামী বিশ্ববিদ্যালয় কিছু মৌলিক শৃঙ্খলা আরোপ করে, তাহাতে রে রে করিয়া প্রতিবাদমুখর হইবার কোনও সুযুক্তি নাই। পাশাপাশি, কর্তৃপক্ষেরও কিছু দায় আছে। কোনটি মৌলিক, কোনটি তত মৌলিক নহে, তাহাও ভাবিতে হইবে! কলেজ চত্বর নিয়ন্ত্রণ এক কথা, আর সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে কী লেখা হইবে বা হইবে না, তাহা নিয়ন্ত্রণ আর এক কথা। কলেজের ছাত্ররা কে কী মত প্রকাশ করিতেছে, তাহাতে কলেজ ছড়ি ঘুরাইবে কেন? উপাচার্য ও তাঁহার সহায়কমণ্ডলী আরও সতর্ক হউন। গণতন্ত্রের গণ্ডিটি পার হইয়া বাহিরে আসিলেই ‘সু’কাজ কিন্তু ‘কু’রূপ ধারণ করিতে পারে। |