|
|
|
|
|
|
|
চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১... |
|
অনুভব করা যায় ধ্রুপদী চেতনার মধ্যেও আধুনিক ভাষা |
সম্প্রতি স্কাল্পচার গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত হল তাপস সরকারের একক প্রদর্শনী। লিখছেন মৃণাল ঘোষ |
সম্প্রতি যাদবপুরের স্কাল্পচার গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত হল তাপস সরকারের বড় ও ছোট ২৮টি ব্রোঞ্জ-ভাস্কর্য নিয়ে একক প্রদর্শনী। ভারতের প্রতিষ্ঠিত ও সুখ্যাত ভাস্করদের অন্যতম এই শিল্পী ১৯৭৫-এ কলকাতার গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজ থেকে ভাস্কর্যে স্নাতক শিক্ষা শেষ করে চিত্র ও ভাস্কর্য উভয় মাধ্যমেই নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছেন। তাঁর প্রকাশভঙ্গি বহুমুখী। কিন্তু এর মধ্যেও একটি কেন্দ্রীয় ঐক্য আছে। সেটাকে বলা যেতে পারে দেশীয় ঐতিহ্য অন্বিত রূপারোপ। পাশ্চাত্য আধুনিকতার নানা রূপপদ্ধতি ও পরীক্ষা-নিরীক্ষাকে তিনি খুব তন্নিষ্ঠভাবে আত্মস্থ করেছেন। এবং তাকে দেশীয় ধ্রুপদী ও লৌকিক নান্দনিক চেতনার সঙ্গে সুচারুভাবে মিলিয়ে দিয়েছেন। সেখানে সমাজ সমালোচনামূলক প্রতিবাদী চেতনা যেমন আছে, তেমনি আছে প্রজ্ঞাদীপ্ত ধ্রুপদী অন্বেষণ। আলোচ্য প্রদর্শনীর রচনাগুলিতে এই দু’টি অভিমুখই আমরা দেখি, যদিও ধ্রুপদী আধ্যাত্মিকতার প্রকাশই বেশি। |
|
শিল্পী: তাপস সরকার |
এ পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন বড় শহরে তাঁর ১৫টি একক ও ৯টি যুগ্ম প্রদর্শনী হয়েছে। এছাড়া দেশ-বিদেশ মিলিয়ে সম্মেলক প্রদর্শনীর সংখ্যা শতাধিক। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এ পর্যন্ত ৩৪টি বড় মাপের ইনস্টলেশনধর্মী ভাস্কর্য তিনি করেছেন যাদের উচ্চতা ১৩ থেকে ৫৫ ফুট। এ সব কাজেও প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য নানা ঐতিহ্যের সমন্বয় আছে। এই সমন্বয়ের মধ্য দিয়েও দেশীয় ঐতিহ্যগত ভাবধারার প্রকাশই প্রাধান্য পেয়েছে। তাঁর শিল্পীজীবনের বা কর্মজীবনের শুরুতে তাপস কিছু দিন চাকরিসূত্রে ইন্ডিয়ান মিউজিয়মের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সেখানে ভারতীয় ধ্রুপদী ভাস্কর্যের বহু প্রতিলিপি তাঁকে করতে হয়েছে। এই পর্যায়েই ১৯৮০-র দশকের মাঝামাঝি সময়ে কলকাতার ব্রিটিশ কাউন্সিলের প্রাঙ্গণে স্ক্র্যাপ মেটাল বা পরিত্যক্ত যন্ত্রাংশ জুড়ে পরিবেশ-ভাস্কর্যের একটি প্রদর্শনী করেন।
তাপস শিল্পকলার এক জন বিশিষ্ট সংগঠক। ভারতে কেবলমাত্র ভাস্করদের একমাত্র সংগঠন ‘ক্যালকাটা স্কাল্পটর্স’ দলের প্রতিষ্ঠাতা তিনি। সম্প্রতি এক নতুন আঙ্গিকে তিনি কাজ করেছেন। ২০১১-র দিল্লি আর্ট সামিটে সেই কাজের প্রদর্শনী সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে বিশেষ অভিঘাত সৃষ্টি করেছে। কালীঘাটের পটচিত্রের আঙ্গিককে তিনি ত্রিমাত্রিক ভাস্কর্যে রূপান্তরিত করেছেন। ফাইবার গ্লাসের সে সমস্ত বর্ণিল কাজে কালীঘাটের আঙ্গিকের মধ্যে দিয়ে তিনি উপস্থাপিত করেছেন সমকালীন সামাজিক পরিস্থিতির নানা সমালোচনা।
আলোচ্য প্রদর্শনীর ব্রোঞ্জগুলিতে তাঁর ভারতীয় ধ্রুপদী রূপভাবনার প্রকাশই বেশি। বুদ্ধ, কৃষ্ণ, ‘মেধা’ শিরোনামে তানপুরা হাতে সরস্বতী, মঙ্গলঘট কোলে নিয়ে উপবিষ্টা লক্ষ্মী, গণেশজননী মাতৃমূর্তি, ‘সিদ্ধিবিনায়ক’, ‘বুদ্ধিনাথ’, ‘কপিলা’, ‘বালগণপতি’, ‘নিদীশ্বরম’, ‘হরিদ্রা’, ‘ভীমা’ ইত্যাদি বিভিন্ন শিরোনামে গণেশের রূপারোপ সেই ধ্রুপদী চেতনারই বিভিন্ন প্রকাশ। বুদ্ধ, সরস্বতী বা ‘মুরলীধর’ শিরোনামে কৃষ্ণের রূপারোপে অবয়ব বিন্যাসে তিনি শীর্ণতার মধ্যে দীর্ঘায়ত এক সুস্মিত ছন্দের বিন্যাস ঘটিয়েছেন। ভারতীয় ধ্রুপদীচেতনার এক আধুনিক ভাষ্য অনুভব করা যায় এখানে। ‘ইনোসেন্ট বিউটি’ শিরোনামে এক তরুণীর মুখাবয়ব রচনায় রয়েছে স্বাভাবিকতার সঙ্গে অন্তর্মুখীনতার সুষম সমন্বয়। রবীন্দ্রনাথের মুখাবয়বটিতে অভিব্যক্তিবাদী প্রকাশের ভিতর কবির চিন্তামগ্ন অন্তর্দীপ্তির অসামান্য প্রকাশ ঘটেছে। আবার ‘ফ্লাইং বার্ডস’ শীর্ষক প্রায় বিমূর্ত রচনাটিতে তিনটি দণ্ডের উপর স্থাপিত অজস্র উড়ন্ত পাখির রূপারোপে দেশীয় ঐতিহ্যের এক কাব্যময় সৌন্দর্য উপস্থাপিত করেছেন এই শিল্পী। কালীঘাটের পটচিত্রের আঙ্গিকে করা কাজ এই প্রদর্শনীতে মাত্র একটিই ছিল। ‘বোষ্টম-বোষ্টমী’ শীর্ষক রচনাটি এখানে তিনি ব্রোঞ্জে করেছেন। দু’টি নধর বিড়াল বসে আছে পাশাপাশি, মুখোমুখি। মুখে তারা ধরে রেখেছে একটি ফুলন্ত লতা। ছায়াচ্ছন্ন ধূসর পাতিনায় করা এই মার্জারযুগল ফাইবার গ্লাসের উদ্ভাসিত বর্ণবৈচিত্র থেকে বিচ্যুত হয়ে যেন গাম্ভীর্যময় এক নতুন নান্দনিক বিভা পেয়েছে। ফাইবার গ্লাসের বর্ণিলতায় যা অনেক সময়ই তরল হয়ে যাচ্ছিল। ‘বোষ্টম-বোষ্টমী’ সেই সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে স্বতন্ত্র নান্দনিক মর্যাদায় উন্নীত হতে পেরেছে। |
|
|
|
|
|