একুশ শতকে ক্রীতদাস! তা-ও আবার খাস লন্ডনের বুকে।
দীর্ঘ তিন দশক ধরে তিন জন মহিলাকে বাড়িতে বন্দি করে রেখেছিল এক দম্পতি। গত মাসে এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা উদ্ধার করে তাঁদের। জেরার জন্য কাল সকালে দক্ষিণ লন্ডনের ল্যামবেথের বাসিন্দা ওই দম্পতিকে আটক করে পুলিশ। চাঞ্চল্যকর এই ঘটনা সামনে আসে এর পরই।
যে তিন মহিলাকে উদ্ধার করা হয়েছে তাঁদের মধ্যে এক জন মালয়েশিয়ার। বয়স প্রায় ৭০ ছুঁইছুই। ৫৭ বছর বয়সি দ্বিতীয় মহিলা আয়ার্ল্যান্ডের বাসিন্দা। তিন জনের মধ্যে সব চেয়ে ছোট যিনি, তিনি ব্রিটিশ। বয়স ৩০ এর কোঠায়। তদন্তকারীদের অনুমান জন্মের পর থেকেই ক্রীতদাসীর জীবন শুরু হয়েছিল তাঁর। তৃতীয় জনের সঙ্গে ধৃত দম্পতির কোনও রকম আত্মীয়তা আছে কি না, তা-ও খতিয়ে দেখছে পুলিশ। তাঁদের অনুমান, তিন-তিনটে দশক বাড়িতে আটকে রেখে, জোর-জবরদস্তি করলেও এই মহিলাদের উপর যৌন নির্যাতন চালানো হয়নি। ধৃত দম্পতির পরিচয় এখনও প্রকাশ করেনি পুলিশ। শুধু জানা গিয়েছে, তাঁরা আদতে ব্রিটেনের বাসিন্দা নন। এবং দু’জনেরই বয়স ৬৭।
গোয়েন্দাপ্রধান কেভিন হাইল্যান্ডের কথায়, “দশ বছর পর্যন্ত বন্দি করে রাখার কথা আগে তা-ও শোনা গিয়েছে। কিন্তু ৩০ বছরের বন্দিনী জীবন! হলফ করে বলতে পারি এ দেশে এমন ঘটনা কেউ শোনেনি।”
কী ভাবে প্রথম প্রকাশ্যে এল তিন বন্দিনীর কথা? বিলেতে জোর করে বিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তোলার কাজ করে কাজ করে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ফ্রিডম চ্যারিটি। হঠাৎই তাদের দফতরে ফোন আসে এক দিন। এক মহিলা কণ্ঠ ভয়ে ভয়ে জানায়, তিন দশক হল বাইরের জগৎটা চোখেই দেখেননি তিনি। দেখবেনই বা কী করে, জীবনের বেশির ভাগ সময়টাই যে তাঁকে কাটাতে হয়েছে ঘুপচি ঘরে। মালিকের খিদমত খাটতে খাটতে। শুধু তিনিই নন, একুশ শতকের লন্ডনে তাঁরই মতো দাস-জীবন কাটাচ্ছেন আরও দুই মহিলা।
সংস্থার কর্ত্রী অনীতা প্রেম বলেন, “ফোনটা ধরার পর কী রকম যেন হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। আতঙ্ক-উৎকণ্ঠা মেশা গলাটা ভুলতে পারছিলাম না। তিন-তিনটে দশক আগে থমকে গিয়েছে যাঁদের জীবন, কী ভাবে তাঁদের সাহায্য করব বুঝেই উঠতে পারছিলাম না। মানুষের প্রতি এঁদের বিশ্বাস ফিরিয়ে আনাটাই ছিল আমাদের প্রথম কাজ।” এর পর মালিকের চোখের আড়ালে শুরু হয় ফোনে যোগাযোগের পর্ব।
গত ২৫ অক্টোবর শেষ পর্যন্ত বাড়ির বাইরে পা দেন ওই তিন বন্দিনী। অখ্যাত রাস্তার অতি সাধারণ বাড়িটির বাইরে তখন ভিড় জমান পুলিশ ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মীরা। অনীতার কথায়, “ওঁরা বাইরে এসেছেন, খবর পেয়েই হাততালিতে ফেটে পড়েন আমাদের কর্মীরা। চোখ ভিজে আসে অনেকের।” উদ্ধারের পর তিন জনকে নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠিয়েছে পুলিশ।
মুক্তি মিললেও আতঙ্কের রেশ কিন্তু কাটেনি এখনও। তাঁদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা চালাচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মীরা। তবে জীবনের উপর থেকেই ভরসা উঠে গিয়েছিল যাঁদের, মন খুলে কথা বলতে এখন তেমন স্বচ্ছন্দ নন তাঁরা। “তার জন্যই জিজ্ঞাসাবাদ করে সব জানতে এত বেশি সময় লেগে যাচ্ছে। ওঁদের উদ্ধার করার পর মালিককে আটক করতে প্রায় এক মাস সময় পেরিয়ে গেল,” বললেন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাটির আর এক কর্ত্রী বিনীতা থর্নিল।
মূক-বধির তরুণীকে ঘরবন্দি করে রাখা বা নিজেরই মেয়ের উপর অকথ্য যৌন নির্যাতন চালানোর মতো ঘটনা প্রকাশ্যে এসেছে এর আগেও। আমেরিকার ওহায়োয় তিন তরুণীকে অপহরণ করে টানা দশ বছর ধরে ধর্ষণ করেছিল এরিয়াল কাস্ত্রো। হালফিলের এই ঘটনায়ও হইচই কম হয়নি। কিন্তু ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের কথায়, লন্ডনের এই ঘটনার সঙ্গে অন্যগুলির একটা ফারাক রয়েছেই। দশ-বারো বছর বন্দি জীবনের কাহিনি শোনা গেলেও তিরিশ বছর একটানা আটকে রাখার কথা আগে কখনও শোনা যায়নি। ব্রিটেনে তো নয়ই।
মানুষ পাচার সংক্রান্ত ব্রিটেনের বিশেষ দূত অ্যান্টনি স্টিন অবশ্য ততটা বিস্মিত নন। তাঁর কথায়, “দাসপ্রথা ইতিহাসের পাতায় আটকে আছে, ভুলেও তা ভাববেন না। বেশির ভাগ ঘটনাই সামনে আসে না। আমরা যতটা ভাবতে পারি, আধুনিক দাসেদের সংখ্যা আসলে তার চেয়েও বহু গুণ বেশি।” এ রকম সামাজিক ব্যাধি আটকাতে হলে কড়া আইনই একমাত্র দাওয়াই, মত লেবার এমপি ফ্রাঙ্ক ফিল্ডের। |