সারিবদ্ধ বিছানায় রোগীরা শুয়ে আছেন। কিন্তু বিছানায় পাতা নেই কোনও চাদর। পরিদর্শনে আসা রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের দলের জিজ্ঞাসা, কেন রোগীদের বিছানায় চাদর নেই? উত্তর এল চুরি হয়ে গিয়েছে। শুধু চাদর চুরি নয়, রামপুরহাট মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগীদের দুর্দশা দেখে তাঁরা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে প্রশ্ন করলেন, সিউড়িতে সদর হাসপাতালে তো এসব দেখলাম না। ওখানকার মানুষ আর এখানে যাঁরা ভর্তি হতে আসছেন তাঁরা কি আলাদা? তাঁরা হাসপাতাল সুপারকে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা তা নেওয়ার কথা বললেও অবস্থার উন্নতি হয়নি।
রামপুরহাট মহকুমা হাসপাতালকে জেলা হাসপাতাল হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। তাই রবিবার এই হাসপাতালে পরিদর্শনে এসেছিলেন রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের ‘মাল্টি ডিসিপ্লিনারি এক্সপার্ট গ্রুপের চেয়ারপার্সন চিকিৎসক সুব্রত মৈত্র এবং চিকিৎসক সমুদ্র সেনগুপ্ত-সহ অন্য সদস্যরা। তাঁরা চলে যাওয়ার পরে মাঝে চারটে দিন কেটে গিয়েছে। কিন্তু অবস্থার কোনও পরিবর্তন হয়নি। |
বৃহস্পতিবার সকালে মহিলা বিভাগে গিয়ে দেখা গেল, মাত্রা দু’জন রোগীর বিছানার চাদর পাতা রয়েছে। জ্বরে আক্রান্ত এগারো বছরের কিশোরীকে নিয়ে তিন দিন থেকে হাসপাতালে রয়েছেন রামপুরহাট থানার দখলবাটি গ্রামের এক বধূ। তিনি বললেন, “চাদর চাইনি। নিয়মই তো আছে রোগী ভর্তি হলে সঙ্গে বিছানার চাদর দেওয়া হবে। হাসপাতাল থেকে না দেওয়ার জন্য বাড়ি থেকে নিয়ে আসা চাদর ব্যবহার করছি।” যেখানে ওই কিশোরীটি শুয়ে আছে, সেখানে দেখা গেল জানলার কাচ ভাঙা। এরকম ওয়ার্ডের প্রায় প্রতিটি জানলার কমবেশি কাচ ভাঙা। ওই ওয়ার্ডে ভর্তি থাকা রোগী ফিরদৌসি বিবি বললেন, “রাতে জানলা দিয়ে হু হু করে ঠান্ডা হাওয়া ঢুকছে। শীতে কষ্ট হয়।” হাসপাতালের চার তলায় পুরুষ বিভাগে থাকা ডালিম খলিফা, খাইরুল আলমরা শ্বাসকষ্ট জনিত রোগের চিকিৎসার জন্য এখানে ভর্তি হয়েছেন। তাঁদের কথায়, “জানলার কাচ ভাঙা। দিনের বেলায় যা ঠান্ডা লাগছে, রাতে কী হবে জানি না!”
পুরুষ বিভাগে অবশ্য দেখা গেল, বুধবার রাতে বা বৃহস্পতিবার সকালে যে সমস্ত রোগী ভর্তি হয়েছেন, তাঁদের বাদ দিয়ে অন্যান্য রোগীর বিছানায় চাদর দেওয়া হয়েছে। ওই বিভাগের দায়িত্বে থাকা নার্স জানালেন, গত আগস্ট মাস থেকে এই বিভাগের দায়িত্বে নিয়েছেন তিনি। তখন হাতে পেয়েছিলেন ২০০টি বিছানার চাদর। কিন্ত এখন সেই সংখ্যা কমে ১০০তে ঠেকেছে। কিন্তু কেন এমন অবস্থা? হাসপাতাল সুপার হিমাদ্রি হালদার বলেন, “যদি ১০০টা চাদর দেওয়া হয়, ২-৩ দিনের মধ্যে সেই সংখ্যা ৫০-এ দাঁড়ায়।” সাত বছর ওই পদে আছেন সুপার। তিনি বলেন, “নিরাপত্তা ব্যবস্থার ত্রুটির জন্য এটা হচ্ছে। কে কী নিয়ে ঢুকছে আর কী নিয়ে বেরোচ্ছে সেটা নজরদারির অভাব যেমন আছে, তেমনই প্রত্যেকের সঠিক ভাবে কাজের মানসিকতারও অভাব বোধ থেকে এই সব হচ্ছে।”
ঠান্ডার সময় রোগীর বিছানায় চাদর না থাকা কিংবা জানলার কাচ ভাঙা এই সবগুলির ক্ষেত্রে কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে? প্রশ্নে রামপুরহাট জেলা হাসপাতালের মুখ্যস্বাস্থ্য আধিকারিক রাধানাথ মাড্ডি বলেন, “সুপার হচ্ছেন একজন প্রশাসক। আমরা তাঁদেরকে চালনা করি। একটা হাসপাতালে কোথায় কী গলদ আছে তাঁর চেয়ে ভাল কেউ জানেন না। সুতরাং তাঁকেই আগে কড়া হাতে ব্যবস্থা নিতে হবে।” এ প্রসঙ্গে সুপার বলেন, “হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডের পরিকাঠামো গত উন্নয়নের জন্য প্রায় ১ কোটি টাকার একটি পরিকল্পনা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো আছে। অনুমোদন না পাওয়া পর্যন্ত যা হয়ে আছে তার উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব নয়। তবুও যেখানে কাচ ভেঙে আছে সেগুলি পরিবর্তন করার চেষ্টা চালানো হবে। আর রোগীকল্যাণ সমিতিতে বিছানার চাদর চুরি ঠেকাতে এবং কেনার ব্যাপারে আলোচনা করা হবে।” রামপুরহাট হাসপাতালের রোগীকল্যাণ সমিতির সভাপতি তথা বিধায়ক আশিস বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “একজন রোগী হাসপাতালে গিয়ে ভর্তি হবে আর বিছানার চাদর পাবে না, এটা সত্যিই লজ্জার। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সুপারকে বলব।” বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখার আশ্বাস দিয়েছেন রামপুরহাট মহকুমাশাসক রত্নেশ্বর রায়। কেউ ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিচ্ছেন, কেউ বা অন্যের ঘাড়ে বিষয়টি চাপিয়ে কার্যত সরে পড়ছেন। কিন্তু এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি হাসপাতালের নানাবিধ সমস্যা কবে মিটবে বা কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে তার স্পষ্ট উত্তর কারও কাছ থেকে মেলেনি। |