|
|
|
|
সম্পাদকীয় ১... |
এই ভাবেই |
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী প্রতি দিন যত রকম কাজ, যে দ্রুত গতিতে করিয়া থাকেন, অনেকের নিকটই তাহা অবিশ্বাস্য ঠেকিবে। ঈর্ষণীয়ও। তবে, আর পাঁচ জনের ন্যায় তাঁহারও দিনে চব্বিশটিই ঘণ্টা। অন্য অনেকের সহিত তাঁহার ফারাক হইল, মুখ্যমন্ত্রীর দিনের চব্বিশ ঘণ্টার উপর দাবি গোটা রাজ্যের, এখন সম্ভবত দেশেরও। অতএব, তিনি তাঁহার সময় এবং শক্তি কোন কাজে ব্যয় করিবেন, এবং কোন কাজটি এড়াইয়া চলিবেন, তাহা বিবেচনার বিষয়। কোনও একটি বিষয়ে বিশেষ ভাবে জড়াইয়া পড়িয়া অন্য কোনও বিষয়কে উপেক্ষা করিবার বিলাসিতা করিবার উপায় রাজ্যের প্রধানের নাই। অর্জুনের ন্যায় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকেও পাখির চোখ দেখিতে হয় কিন্তু তাঁহার ক্ষেত্রে রাজ্যের সার্বিক পরিস্থিতির সবটুকুই সেই নিশানা। সম্ভবত তিনি নিজেও জানেন, এমন অনেক কাজ তিনি করেন, অথবা তাঁহাকে করিতে হয়, যেগুলি তাঁহার করিবার কথা নহে। তিনি ক্ষুণ্ণ স্বরেই প্রশ্ন করিয়াছেন, সকালে উঠিয়া বাজারে লবণ বা আলুর জোগান ঠিক আছে কি না, তাহা দেখা কি আমার কাজ? তাঁহার ক্ষোভ যথার্থ। কাজটি প্রশাসনের। সেই কাজে প্রশাসন ব্যর্থ বলিয়াই মুখ্যমন্ত্রীকে করিতে হইতেছে।
সমস্যাটি আজকের নহে। তাঁহার শাসনকালের প্রথম দিন হইতেই স্পষ্ট হইয়াছিল যে মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁহার প্রশাসনের উৎসাহ ও তৎপরতায় ফারাক বিস্তর। মুখ্যমন্ত্রী অন্যের কাজ নিজে করিয়া সেই ফাঁক ঢাকিতে চেষ্টা করিয়া আসিতেছেন। বহু খুঁটিনাটি তিনি নিজেই দেখেন। তাহাতে সেই কাজের সুরাহা হইলেও বৃহত্তর প্রশাসনের কাজ অবহেলিত হয়, অন্যরা কাজ না করিয়াও পার পাইয়া যান। আশা করা যায়, এই সমস্যা তিনি টের পাইয়াছেন। ফারাক কমাইবার যথার্থ উপায়: কর্মীদের কাজ করিতে বাধ্য করা। নামমাত্র নহে, প্রকৃত কাজ। অধুনা মুখ্যমন্ত্রী সেই চেষ্টা করিতেছেন। তিনি কঠোর সুরে বলিয়াছেন, কাজ ফেলিয়া রাখিলে চলিবে না। তাঁহার তিরস্কার কেবলমাত্র সাধারণ কর্মীদের উদ্দেশেই নহে আমলা এবং মন্ত্রীদের প্রতিও বটে। সরকারি দফতরের দীর্ঘসূত্রতা যে তাঁহার না-পসন্দ, এই কথাটি তিনি এই প্রথম বার বলিলেন না। বস্তুত, তাঁহার পূর্বসূরির ‘এখনই করুন’ স্লোগানটি, সামান্য ভিন্ন শব্দে হইলেও, তাঁহার মুখে বেশ কয়েক বার শোনা গিয়াছে। আরও এক বার শোনা গেল।
তিরস্কার অতি জরুরি বস্তু। বিশেষত যে প্রশাসনে তিনি শুরু, তিনিই শেষ সেখানে তাঁহার তিরস্কার আরও কার্যকর হইবারই সম্ভাবনা। কিন্তু কেবল তিরস্কার যথেষ্ট নহে। অনুমান করা চলে, আড়াই বৎসরের অভিজ্ঞতায় মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং এই কথাটি বুঝিয়াছেন। যে কাজ আছে, তাহা এখনই করিতে হইবে তো বটেই কী ভাবে করিতে হইবে, তাহাও ছকিয়া দেওয়া প্রয়োজন। মুখ্যমন্ত্রী ‘প্রশাসনিক ক্যালেন্ডার’ চালু করিয়া সেই কাজটিই করিলেন। সত্য, এই ক্যালেন্ডারের ধারণাটি মুখ্যমন্ত্রীর নিজস্ব উদ্ভাবন নহে, কর্পোরেট দুনিয়ায় ইহাই পরিচিত পদ্ধতি। কিন্তু সরকারের অন্দরমহলে ইহা একটি ‘ইউরেকা’ মুহূর্তই বটে। কোন কাজ কী ভাবে করিতে হইবে, তাহার জন্য কত সময় প্রয়োজন, কোন ধাপ কত দিনে শেষ হইবে কাজ শুরু করিবার সময়েই যে এই হিসাবগুলি কষিয়া লইতে হয়, পশ্চিমবঙ্গের সরকারি কর্তারা সে কথা জানিতেন বলিয়া মনে হয় না, জানিলেও দীর্ঘ অনভ্যাসে ভুলিয়া গিয়াছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী মনে করাইয়া দিয়াছেন। কেন এই প্রাথমিক কথাটিও তাঁহাকেই বলিয়া দিতে হইবে, অভিজ্ঞ আধিকারিকরা স্বপ্রবৃত্ত হইয়া প্রশাসনের প্রাথমিক নিয়মগুলি কার্যকর করিবেন না, সে সকল অপ্রিয় প্রশ্ন থাক। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ পালিত হয় কি না, তিনি এই চাপ বজায় রাখিতে পারেন কি না, তাহাই এখন দেখিবার। আপাতত পরিবর্তনের মৃদুমন্দ আভাস মিলিতেছে। বাঙালির পক্ষে ইহাও কম নহে। |
|
|
|
|
|