রাত আটটার পরে ক্যাম্পাসে থাকা যাবে না। ক্যাম্পাসে বসে মাদক নেওয়া চলবে না। বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে সোশ্যাল মিডিয়ায় নিন্দেমন্দ করা চলবে না।
প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের জন্য এ বার এই আচরণবিধি জারি হতে চলেছে। বৃহস্পতিবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এ কথা জানিয়ে বলেন, শীঘ্রই ওই আচরণবিধি লিখিত আকারে প্রকাশ করা হবে। কিছু পড়ুয়ার বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগকে কেন্দ্র করে গত ক’দিন ধরে প্রেসিডেন্সি চত্বরে যে উত্তেজনা-প্রতিবাদ জমছিল, সেই প্রেক্ষাপটেই কর্তৃপক্ষ এই রাস্তায় হাঁটলেন বলে মনে করা হচ্ছে।
সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের দেওয়ালে আঁকা ছবি নিয়ে বিতর্ক এবং ক্যাম্পাসে বসে নেশাভাঙ করার অভিযোগের জেরে এক দল ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে কর্তৃপক্ষের বিরোধ বাধে। ধর্ষণ-বিরোধী প্রচারের জন্য এই ছাত্রছাত্রীরা ক্যাম্পাসের দেওয়ালে একটি ছবি এঁকেছিলেন। ছবিটিকে অশালীন আখ্যা দিয়ে কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেন এক দল পড়ুয়া। কর্তৃপক্ষ ছবিটি মুছে দেন। সংশ্লিষ্ট ১২ জন ছাত্রছাত্রীর বিরুদ্ধে নেশা করে বিশৃঙ্খল আচরণের অভিযোগও ওঠে। কর্তৃপক্ষ
ওই ১২ জনের অভিভাবককে ডেকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন। কেন এই পদক্ষেপ, তা জানানোর দাবিতে বুধবার রাতভর অনশন করেন এঁদের মধ্যে তিন জন। বৃহস্পতিবার দুপুরে উপাচার্য মালবিকা সরকারের সঙ্গে দেখা করেন ওই পড়ুয়ারা। তার পর অনশন প্রত্যাহার করে নেন। সোমবার বেলা ১২টায় বিশ্ববিদ্যালয়ে শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির বৈঠকে অভিযুক্ত ছাত্রছাত্রী এবং তাঁদের অভিভাবকদের উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে। ওই বৈঠকের পরেই নয়া আচরণবিধি প্রকাশ হবে বলে খবর।
এ শহরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে পড়ুয়াদের জন্য এই জাতীয় আচরণবিধি কার্যত বেনজির। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট (আইআইএম) কলকাতা বা শিবপুরের বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড সায়েন্স ইউনিভার্সিটি (বেসু) কোথাওই এমন আচরণবিধি নেই। একমাত্র ব্যতিক্রম কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, সেখানে অনেক আগে থেকেই কিছু আচরণবিধি চালু রয়েছে। তাতে ক্যাম্পাসে কোথায় কোথায় পোস্টার সাঁটা, মাইক বাজানো, স্লোগান দেওয়া যাবে বা যাবে না, তা বলা আছে। কিন্তু ছাত্রছাত্রীদের গতিবিধি বা বক্তব্য প্রকাশের উপরে রাশ টানার উদ্যোগ সেখানেও নেই।
প্রেসিডেন্সি কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে কী বলছেন? তাঁদের বক্তব্য, নেশাভাঙকে প্রশ্রয় না-দেওয়াটা (জিরো টলারেন্স) কেমব্রিজ বা অক্সফোর্ডের মতো আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয়েরও নিয়ম। সন্ধেবেলা একটা নির্দিষ্ট সময়ের পরে ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যাওয়ার নিয়মটা প্রেসিডেন্সিতে বরাবরই ছিল। এত দিন তা কার্যকর করা হয়নি। এ বার হবে। আর সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে মন্তব্য নিয়ে কড়াকড়ি? বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রশাসনিক কর্তা বলেন, “নিরন্তর নজরদারি চালানো তো সম্ভব নয়। কিন্তু ছাত্রছাত্রীদের শুভবুদ্ধির কাছে আবেদন তারা যেন এটা বোঝে যে, নিজের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সম্বন্ধে কুৎসা করলে সেটা তাদের কাছেও অপমানজনক।” উপাচার্যও এ দিন বলেন, “ক্যাম্পাসে নেশাভাঙ করাকে একদম প্রশ্রয় দেওয়া হবে না।” তাঁর মতে, ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে শৃঙ্খলা বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। না হলে পঠনপাঠনের মান উন্নত হয় না।
সেই লক্ষ্যেই আচরণবিধি তৈরি করা হয়েছে। সম্প্রতি স্কটিশচার্চ কলেজের একটি অনুষ্ঠানে আচার্য-রাজ্যপাল এম কে নারায়ণনও বলেছেন, “জ্ঞানের ভিত্তি শৃঙ্খলার মধ্যে নিহিত।”
শৃঙ্খলা রক্ষায় প্রেসিডেন্সির এই পদক্ষেপ নিয়ে অবশ্য নানা জনের নানা মত। কেউ কেউ মনে করছেন, আচরণবিধি থাকাই উচিত। এতে পড়ুয়াদের ভাল হবে। কারও কারও মত, এমন আচরণবিধি গণতন্ত্রবিরোধী। আবার অনেকের বক্তব্য, আচরণবিধি চালু করতে হলে তা ছাত্রছাত্রীদের কথা বলে তবেই করা উচিত। উপর থেকে চাপিয়ে দিয়ে লাভ হবে না।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সুরঞ্জন দাস যেমন বলেন, “আমাদের আচরণবিধি আছে। সাম্প্রতিক কিছু ঘটনার প্রেক্ষিতে সেই আচরণবিধি কিছুটা ঢেলে সাজাও হচ্ছে। কিন্তু আমরা সকলের মতামত নিয়েই এই আচরণবিধি প্রণয়ন করেছি। কোনও কিছু চাপিয়ে দেওয়া হয়নি।” বেসু-র উপাচার্য অজয় রায় বলেন, “বেসু-তে শৃঙ্খলা এমনিতেই বজায় আছে। তাই আলাদা করে কোনও নির্দেশিকা জারির প্রয়োজন বা পরিকল্পনা নেই।” যাদবপুরের সহ-উপাচার্য সিদ্ধার্থ দত্তের বক্তব্য, “অভিজ্ঞতা থেকে জানি, যে কোনও সমস্যাই আলাপ আলোচনা করে মেটানো যায়। চাপিয়ে দিয়ে কাজের কাজ হয় না।” অনেকটা একই মত বিজ্ঞানী বিকাশ সিংহেরও। প্রেসিডেন্সির প্রাক্তনী বিকাশবাবু মনে করেন, “জোর করে আচরণবিধি চাপিয়ে ক্যাম্পাসে শৃঙ্খলা বজায় রাখা যায় না। এ জন্য ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তুলতে হবে।”
অন্য দিকে আর এক প্রেসিডেন্সি-প্রাক্তনী, একাধারে রাজনীতিক ও আইনজীবী অরুণাভ ঘোষের প্রশ্ন, “চাকরিক্ষেত্রে নিয়ম-শৃঙ্খলা বজায় রাখার নিয়ম থাকলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে থাকবে না কেন! ক্যাম্পাসে নেশাভাঙ, ইচ্ছেমতো আসা-যাওয়ায় লাগাম পরানো তো অবশ্যই দরকার। আর সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে বা সামাজিক অনুষ্ঠানে প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে কুৎসা করাকেও সমর্থন করা যায় না!” হুবহু এক কথা বললেন ইন্টারনেটে ব্যঙ্গচিত্র ছড়ানোর দায়ে গ্রেফতার হওয়া যাদবপুরের শিক্ষক অম্বিকেশ মহাপাত্রও। “সমালোচনা করার জন্য কোনও মঞ্চ বা নেটওয়ার্ককে ব্যবহার করাই যায়। কিন্তু কুৎসা করা ঠিক নয়।”
একমত হতে পারছেন না প্রেসিডেন্সির প্রাক্তনী সংসদের সম্পাদক বিভাস চৌধুরী। তাঁর মতে, “নেশাভাঙ অবশ্যই বন্ধ করা উচিত। কিন্তু কারও ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ ঠিক নয়। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে কিছু লেখা বা না-লেখাটা এক জনের ব্যক্তিগত ব্যাপার।” প্রাক্তনীদের মধ্যে আরও অনেকেই মনে করছেন, প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার হাওয়া সব সময়েই প্রেসিডেন্সির সঙ্গে জড়িয়ে থেকেছে। সেটাই প্রেসিডেন্সির বিশেষত্ব। এই জাতীয় আচরণবিধি সেই ঐতিহ্যের সঙ্গে একটু বেমানান। সত্তর দশকের নকশাল নেতা, প্রেসিডেন্সি প্রাক্তনী অসীম চট্টোপাধ্যায় বলছিলেন, সেই উত্তাল সময়েও কিন্তু প্রেসিডেন্সিতে আচরণবিধির লাগাম পরানোর কথা ভাবা হয়নি! এই পদক্ষেপকে ‘গণতন্ত্রবিরোধী’ বলে তাঁর বক্তব্য, “ফরমান জারি করে কাজের কাজ কিছু হবে না।”
মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা গিয়েছে প্রেসিডেন্সির বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেও। স্নাতকোত্তর দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী প্রজ্ঞা দেবনাথ এবং দেবর্ষি চক্রবর্তী দু’জনেই ক্যাম্পাসে নেশা বন্ধের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন। প্রজ্ঞা সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে ব্যক্তিগত আক্রমণ, কুৎসা রোখার উদ্যোগকেও সমথর্ন করছেন। যদিও দেবর্ষির মতে, এটা ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ। প্রজ্ঞা আবার বলছেন, “ক্যাম্পাসে কতক্ষণ থাকা যাবে, তার উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করাকে মোটেই সমর্থন করা যায় না। গুটিকতক ছেলেমেয়ের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগ উঠেছে বলে সকলের উপরে এমন নিয়ম চাপানো ঠিক নয়।” |