সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরে নির্দেশ জারি হতে দেরি হয়নি। রোগী-স্বার্থ রক্ষার সরকারি পরিকল্পনাটি দ্রুত বাস্তবায়নের তাগিদে যথেষ্ট টাকাও মজুত রাখা হয়েছে হাসপাতালের ভাঁড়ারে। অথচ স্রেফ সদিচ্ছা আর উদ্যোগের অভাবে তা প্রায় মাঠে মারা যেতে বসেছে।
গত জুনে পশ্চিমবঙ্গ স্বাস্থ্য দফতরের নির্দেশিকায় বলা হয়েছিল, ক্যানসার-ডায়াবেটিস-হিমোফিলিয়ার ওষুধ নিখরচায় বা কম দামে মিলবে সরকারি হাসপাতালে। সেই মতো হাসপাতালগুলিকে টাকা বরাদ্দ করা হয়। তার পরেও রোগীদের আগের মতোই বাইরে থেকে চড়া দামে ওষুধ কিনতে হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে! অভিযোগের যে ভিত্তি আছে, স্বাস্থ্য-কর্তারা তা মেনে নিয়ে জানিয়েছেন, এই খাতে বরাদ্দের সিংহভাগ হাসপাতালের তহবিলেই পড়ে রয়েছে।
এবং এ জন্য ডাক্তারদের একাংশের দিকে আঙুল তুলছে স্বাস্থ্য ভবন। কর্তাদের দাবি: রোগীর পরিজনকে বাইরে থেকে ওষুধ কিনতে বাধ্য করছেন কিছু চিকিৎসক। এমতাবস্থায় বিভিন্ন হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষও অসহায়তা প্রকাশ করে বলছেন, ডাক্তারেরা না-লিখলে ওষুধ মজুত করে লাভ কী! পুরো ঘটনাক্রমে সরকার অবশ্য যৎপরোনস্তি ক্ষুব্ধ ও বিরক্ত। “রোগী ও একাধিক ওষুধ-সংস্থার কাছ থেকে অভিযোগ আসছিলই। উপরন্তু গত দু’মাসে বিভিন্ন হাসপাতালে প্রেসক্রিপশন-অডিট করে এর প্রাথমিক প্রমাণ মিলেছে। আমরা বিস্তারিত তদন্ত করছি।” বলেন রাজ্যের স্বাস্থ্য-অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী। স্বাস্থ্য-সচিবও উদ্বিগ্ন। ক’দিন আগে তাঁর ডাকা এক বৈঠকে সংশ্লিষ্ট আধিকারিকদের সতর্ক করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয়েছে বলে দফতরের খবর।
সরকারি-বেসরকারি নানা সমীক্ষা অনুযায়ী, ক্যানসার, ডায়াবেটিস বা হিমোফিলিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এ দিকে তার অধিকাংশ ওষুধের দাম আমজনতার ধরাছোঁয়ার বাইরে। যেমন, প্রাপ্তবয়স্ক হিমোফিলিয়া-রোগীর রক্তক্ষরণ রুখতে ব্যবহৃত ‘ফ্যাক্টর-৮’ নামক রক্তের উপাদানের বাজারি দর প্রায় ৪০ হাজার টাকা। ক্যানসারে ব্যবহৃত ট্রাস্টুজুম্যাব ইঞ্জেকশনের একটাতেই পড়ে ৭৫ হাজার! এই জাতীয় বহুমূল্য অথচ প্রয়োজনীয় ওষুধকে সাধারণের নাগালে পৌঁছে দিতে উদ্যোগী হয়েছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই মতো ক্যানসারের সাত রকম, ডায়াবেটিসের আট রকম ও হিমোফিলিয়ার একটি ওষুধকে ‘সরকারি ওষুধ’-এর তালিকায় এনে সেগুলি কিনে মজুত রাখতে স্বাস্থ্য দফতর বিভিন্ন হাসপাতালকে ছ’মাসের জন্য অর্থ বরাদ্দ করে। বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সরকার জানায়, ১ জুন থেকে সরকারি হাসপাতালের আউটডোরে চিকিৎসাধীন বিপিএল রোগীরা নির্দিষ্ট ওষুধ পাবেন বিনা পয়সায়। অনেরা পাবেন অনেক সস্তায় যেমন ৭৫ হাজারের ইঞ্জেকশন ৪৭ হাজারে, ৪০ হাজারের রক্ত-উপাদান ৮ হাজারে।
তা সত্ত্বেও ছবিটা বদলায়নি। আউটডোরে তো বটেই, হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগীদেরও হামেশা ওষুধ জোগাড় করতে বাইরে ছুটতে হচ্ছে বলে বিস্তর অভিযোগ স্বাস্থ্য ভবনের কানে এসেছে। অনেক ক্ষেত্রে শোনা যাচ্ছে, রোগীর পরিবারকে জানানোই হয়নি যে, ওষুধটি তাঁরা নিখরচায় বা নামমাত্র খরচে হাসপাতালে পেতে পারেন। আর এই অজ্ঞতার সুযোগে এক শ্রেণির চিকিৎসক একই ওষুধ তাঁদের বাইরে থেকে কিনে আনতে বলেছেন। আবার যাঁরা সরকারি সিদ্ধান্ত সম্পর্কে অবহিত, তাঁরা কেউ প্রতিবাদ করলে বলা হচ্ছে, হাসপাতালের স্টকে ওষুধ নেই! ওষুধ সরবরাহকারী কিছু সংস্থাও নালিশ জানিয়েছে। সরকারি হাসপাতালে ইনসুলিনের জোগানদার এক সংস্থার কর্তার কথায়, “অনেক ডাক্তার রোগীদের বাইরের দোকানে যেতে বলছেন। হাসপাতালও আমাদের থেকে ওষুধ নিচ্ছে না।” স্বাস্থ্য ভবনের খবর: গত চার মাসে সেন্ট্রাল মেডিক্যাল স্টোর্সে ডায়াবেটিসের ওষুধের বরাতই দেয়নি কোনও সরকারি হাসপাতাল!
হাতে টাকা থাকা সত্ত্বেও কেন এই অবস্থা?
এসএসকেএমের অধ্যক্ষ প্রদীপ মিত্রের বক্তব্য, “ডাক্তারেরা মনে করছেন, সরকারি তালিকার ওষুধের তুলনায় বেশি দরকারি ওষুধ বাইরেই পাওয়া যায়। সেই মতো ওঁরা প্রেসক্রিপশন করছেন। আমাদের কিছু করার নেই।” ন্যাশনাল মেডিক্যালের সুপার পার্থ প্রধানের ব্যাখ্যা, “সরকারি তালিকায় নতুন যুক্ত ৫০-৬০টি মলিকিউল সম্পর্কে ডাক্তারদের অবহিত করা হচ্ছে না। ওঁরা সব সময় জানতে পারছেন না, হিমোফিলিয়া, ডায়াবেটিস বা ক্যানসারের কোন ওষুধ তালিকায় রয়েছে। তাই আগের মতো বাইরে থেকে কিনতে বলছেন।” মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজের সুপার যুগল করের যুক্তি, “এখানে এমন রোগী আসেনই না। সবাই কলকাতা চলে যান। ওষুধ কিনলে তো পড়ে থাকবে!” বাঁকুড়া মেডিক্যালের সুপার পঞ্চানন কুণ্ডু বলেন, “ক্যানসারের ওষুধ কিনেছি। জানতাম না, ডায়াবেটিস বা হিমোফিলিয়ার ওষুধও ওই টাকায় কেনা যাবে।”
সমস্যার উৎস-সন্ধানে গত ৮ নভেম্বর স্বাস্থ্য ভবনে বৈঠক ডেকেছিলেন স্বাস্থ্য-সচিব মলয় দে। সেখানে কলকাতা-সহ বিভিন্ন জেলা হাসপাতালের কর্তারা ছিলেন। দফতর-সূত্রের দাবি, ওষুধ না-কেনার কৈফিয়ৎ তলব করা হলে প্রায় কেউ সদুত্তর দিতে পারেননি। এ জন্য তাঁরা ভর্ৎসিত ও সতর্কিত হয়েছেন। পরে স্বাস্থ্য-সচিব বলেন, “গরিবের সুবিধা করতে নতুন কিছু ওষুধ সরকারি তালিকায় ঢোকানো হয়েছে। তা কিনতে প্রচুর টাকাও বরাদ্দ করা হয়েছে। তবু রোগীকে চড়া দামে বাইরে থেকে ওষুধ কিনতে হচ্ছে! এটা বরদাস্ত করা হবে না।” স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘোষণা, “তদন্তে গাফিলতি প্রমাণিত হলে হাসপাতালের ওষুধ-বাজেট অর্ধেক করে দেওয়া হবে।”
পাশাপাশি সরকারি নির্দেশ ঠিকঠাক কার্যকর করার জন্য বিশেষত মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলোকে এক মাসের সময়সীমাও বেঁধে দিয়েছে স্বাস্থ্য ভবন। “এর মধ্যে সরকার মনোনীত সংস্থা থেকে ওষুধ কেনার পরিমাণ না-বাড়ালে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে।” হুঁশিয়ারি এক কর্তার। |
নিষ্ক্রিয় তহবিল |
হাসপাতাল |
বরাদ্দ |
ব্যয় |
এসএসকেএম |
৮ |
১.৫ |
ন্যাশনাল |
৪ |
১.৫ |
আরজিকর |
৫ |
২ |
বাঁকুড়া |
৪ |
১ |
মেদিনীপুর |
৪ |
১ |
* সব অঙ্ক কোটি টাকায়,
গত ছ’মাসের খতিয়ান
সূত্র: রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর |
|