|
|
|
|
|
পুরভোটে ঝাড়গ্রাম |
বেহাল নিকাশিই বামেদের কাঁটা
কিংশুক গুপ্ত • ঝাড়গ্রাম |
|
একটানা বৃষ্টি হলেই হাইড্রেনের জল উপচে ভাসিয়ে দেয় স্কুল। ক্লাসঘরে জমা নোংরা জলে ঘুরে বেড়ায় বিষাক্ত সাপ ও বিছের দল।
আকাশে মেঘ জমতে দেখলে তাই আশঙ্কায় থাকেন ঝাড়গ্রাম শহরের ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের ‘সানি পয়েন্ট স্কুল’-কর্তৃপক্ষ। নার্সারি থেকে চতুর্থ শ্রেণির খুদে পড়ুয়াদের এই বেসরকারি স্কুলের ভবনটি বছরে একাধিকবার জলবন্দি হয়ে যায়। এ জন্য স্কুলের বার্ষিক ছুটির তালিকার অতিরিক্ত ছুটি সংযোজন করতে বাধ্য হন স্কুল-কর্তৃপক্ষ। প্রধান শিক্ষক তিমির মল্লিক বলেন, “চলতি বছরে সব মিলিয়ে সাত দিন স্কুলবাড়িটি জলবন্দি অবস্থায় ছিল। অতিরিক্ত পাঁচ দিন স্কুল বন্ধ রাখতে হয়েছিল। জল ঢুকে যাওয়ায় স্কুলের আলমারির তলার তাকে থাকা গুরুত্বপূর্ণ বহু নথিপত্র ভিজে নষ্ট হয়েছে। শট সার্কিটে পুড়ে গিয়েছে কম্পিউটার।” তিমিরবাবু জানালেন, নিজেদের উদ্যোগে তাঁরা স্কুল ঘরপরিষ্কার করেন। কিন্তু পাশের অবরুদ্ধ হাইড্রেনের দুর্গন্ধে টেকা যায় না। হাইড্রেনটি জঞ্জালপূর্ণ হওয়ায় দিনেও ক্লাসরুমে মশা মারতে স্প্রে করতে হয়। অথচ স্কুলটি পুরসভার নথিভুক্ত বেসরকারি স্কুল। পুরসভাকে বার্ষিক কর দেন তিমিরবাবুরা। কিন্তু পরিষেবা মেলে না ছিটেফোঁটাও।
জনবহুল অভিজাত এলাকার এই স্কুলটিই ঝাড়গ্রাম শহরের বেহাল নিকাশির সেরা বিজ্ঞাপন! বেহাল নিকাশিতে জর্জরিত বহুতল থেকে বস্তি। ঝাড়গ্রাম পুর-শহরের আয়তন ২১ বর্গ কিলোমিটার। এর মধ্যে রাস্তা ২২০ কিলোমিটার। আর নিকাশি নালা সাকুল্যে ৩৫ কিলোমিটার। বেশিরভাগ রাস্তার ধারে নালা নেই। আগে ছিল ১৭টি ওয়ার্ড। এ বার ওয়ার্ড বেড়ে হয়েছে ১৮টি। অপরিকল্পিত কিছু জঞ্জালভর্তি নালা রয়েছে, কিন্তু কোনও ওয়ার্ডেই নিকাশির ব্যবস্থা নেই। একটু জোরে বৃষ্টি হলেই বস্তি এলাকার সঙ্গে শহরের একাধিক পিচ রাস্তাতেও হাঁটুজল দাঁড়িয়ে যায়। টানা ৩১ বছর ক্ষমতায় থেকেও বামেরা কেন সুষ্ঠু নিকাশি গড়ে তুলতে পারল না, সেই প্রশ্ন তুলেছেন বিদায়ী তৃণমূল পুরপিতা প্রশান্ত রায়, আনন্দমোহন পণ্ডা ও শিউলি সিংহরা। তাঁদের কথায়, “খড়্গপুর আইআইটি’র বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নিয়ে একটা রূপরেখা কী তৈরি করা যেত না?” এ বার পুরভোটে তৃণমূলের পুরপ্রধান পদপ্রার্থী দুর্গেশ মল্লদেবের অভিযোগ, “অন্য বছরগুলির মতো গত পাঁচ বছরেও বামেরা কোনও কাজ করেনি।”
পুর-কর্তৃপক্ষের অবশ্য দাবি, ‘ডি-ক্যাটাগরি’ভুক্ত গত পাঁচ বছরে ৭ কিমি দীর্ঘ নিকাশি নালা তৈরি হয়েছে। ১০ কিমি পিচের রাস্তা হয়েছে। সাড়ে নয় কিমি রাস্তা কংক্রিট দিয়ে বাঁধানো হয়েছে। কিন্তু পুরবাসীর অভিযোগ, অরণ্যশহরে বেশির ভাগ রাস্তাই কাঁচামাটির। পুরসভার পরিসংখ্যানও বলছে, শহরে ২২০ কিমি রাস্তার মধ্যে ৭৫ কিমি এখনও কাঁচা ও ৮১ কিমি মোরামের। মাত্র ৫২ কিমি রাস্তা পিচের। কাজ না করতে পারার ব্যাখ্যা দিয়ে বিদায়ী পুরপ্রধান সিপিএমের প্রদীপ সরকার বলেন, “২০০৮ সালে বোর্ড গঠনের পরে শুরু হয় মাওবাদী-জনগণের কমিটির প্রবল সন্ত্রাস। বারবার শহরকে অবরুদ্ধ করে দিয়ে উন্নয়ন কাজে ওরা ব্যাঘাত ঘটিয়েছিল। খুন হয়েছিলেন শহরের প্রবীণ সিপিএম নেতা গৌর পৈচ্ছা। রাজ্যের বর্তমান শাসকদল তখন জনগণের কমিটিকে মদত জুগিয়েছিলেন। ২০১১ সালে তৃণমূল রাজ্যের ক্ষমতায় আসার পরে ঝাড়গ্রাম পুরসভার বরাদ্দ কমিয়ে দিয়েছে। আর এসবের পরে এখন আমাদের বিরুদ্ধে ব্যর্থতার তকমা লাগানো হচ্ছে।”
শুধু নিকাশি নয়, বাড়ি-বাড়ি পানীয় জল সরবরাহের ব্যবস্থাও নেই। প্রায় ৬২ হাজার মানুষের বাস ঝাড়গ্রামে। পানীয় ও নিত্য ব্যবহার্য মিলিয়ে প্রতিদিন প্রায় ৬ লক্ষ গ্যালন জল প্রয়োজন। জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের সহযোগিতায় শহরের বিভিন্ন রাস্তায় ৯৬০টি টাইম কলের মাধ্যমে দৈনিক মাত্র ২ লক্ষ গ্যালন জল সরবরাহ করা সম্ভব হয় বলে জানিয়েছেন পুর-কর্তৃপক্ষ। যদিও বেশ কয়েকটি টাইম কলে ঠিকমতো জল আসে না। জলের মান নিয়েও অভিযোগ রয়েছে। গ্রীষ্মে একাধিক ডিপ-টিউবওয়েল অকেজো হয়ে গিয়ে জল সঙ্কট বাড়িয়ে তোলে।
রয়েছে আঁধার পথের সমস্যা। শহরের অনেক রাস্তাতেই পথবাতি নেই। ৫ নম্বর ওয়ার্ডের তালড্যাংরার মতো বস্তি এলাকায় বিদ্যুৎ পর্যন্ত পৌঁছয়নি। পরিকল্পনাবিহীন এই শহরের যত্রতত্র জঞ্জালের পাহাড় জমে থাকে। পুরসভার উদ্যোগে জঞ্জাল সাফাইয়ের কোনও ব্যবস্থা নেই। শহরবাসীও মানছেন, রাস্তাঘাট, পানীয় জল থেকে জঞ্জাল সাফাই সবেতেই ডাহা ফেল করেছে বাম পুরবোর্ড। বিগত পুরভোট গুলির ইস্তেহারে বামেরা জল নিকাশির জন্য মাস্টার প্ল্যান ও বাড়ি বাড়ি জল সরবরাহের জন্য নদী ভিত্তিক জলোত্তলন প্রকল্পের প্রতিশ্রুতি বারে বারে দিয়ে এসেছে। কিন্তু তা ইস্তেহার-বন্দি হয়েই থেকে গিয়েছে। এবার পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অবশ্য বামেদের ইস্তেহারে সুনির্দিষ্ট ভাবে ওই দু’টি প্রতিশ্রুতির কথা নেই। আগামী দিনে নিকাশি, পানীয় জল ও রাস্তা সংস্কারে সামগ্রিক উন্নতি ঘটানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বামেরা। অন্যদিকে, তৃণমূল নেতা মুকুল রায় জানিয়ে দিয়েছেন, “ক্ষমতায় এসে দু’বছরের মধ্যে অরণ্যশহরের উন্নয়ন করতে আমরা ব্যর্থ হলে তখন আমাদের প্রত্যাখ্যান করবেন।” শুক্রবার পুরবাসী কাদের প্রত্যাখ্যান করেন, সে দিকেই এখন সকলের নজর। কারণ পুর-নাগরিকরা মনে করছেন, উন্নয়ন-অনুন্নয়নের চুলচেরা ফারাকই এ বার হার-জিত নির্ধারণ করবে। |
|
|
|
|
|