দুব্বুরি সুব্বারাও এখন অতীত, কিন্তু অর্থ মন্ত্রকের সহিত রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সম্পর্কটি সেই অম্লমধুর তারেই বাঁধা রহিয়াছে। মধুরের ভাগ অবশ্য সামান্যই— কোনও পক্ষই এখনও সরাসরি অন্য পক্ষের উপর দোষারোপ করেন নাই। অম্লরসই প্রধান, তাহার কারণ, ব্যাঙ্কের বর্তমান প্রধানও তাঁহার পূর্বসূরির পথেই চলিতেছেন। বস্তুত, তিনি বেশ কয়েক কদম আগাইয়া গিয়াছেন। সুব্বারাও তাঁহার শেষ পর্যায়ে সুদের হার আর বাড়ান নাই। রঘুরাম রাজন ব্যাঙ্কের গভর্নর হওয়ার পর বাড়াইয়াছেন; ফের বাড়াইবেন, তেমন ইঙ্গিতও দিয়া রাখিয়াছেন। সুদের হারের এমন ঊর্ধ্বগতি অর্থমন্ত্রীর পছন্দ হইবার কোনও কারণ নাই। অতএব, সম্পর্কের ওই ক্ষীণ মধুরতাটিই ভরসা, নচেৎ ঠোকাঠুকি লাগিবার শব্দ এত ক্ষণে কানে ভাসিয়া আসিত। সম্প্রতি অর্থনীতির এই দুই কর্তা একই দিনে দুইটি পৃথক মঞ্চে অর্থনীতির স্বাস্থ্য এবং তাহার উদ্ধারের উপায় বিষয়ে বক্তব্য পেশ করিলেন। প্রথম ভাগটিতে তাঁহারা অভিন্নমত— বৃদ্ধির হার উচ্চতর স্তরে লইয়া যাওয়া প্রয়োজন। কিন্তু কী উপায়ে? এই দ্বিতীয় ভাগে দুই কর্তার দুই মত। অর্থমন্ত্রীর মতে, খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণেই যে মূল্যস্ফীতি ঘটিতেছে, কঠোর আর্থিক নীতি তাহাকে ঠেকাইতে পারিবে না। অস্যার্থ, সুদের হার লইয়া বাড়াবাড়ির প্রয়োজন নাই। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক প্রধান একই রকম প্রত্যয়ের সঙ্গে বলিয়াছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করিতে গোটা দুনিয়ার সব কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের হাতেই একটিমাত্র অস্ত্র বর্তমান— সুদের হার। কাজেই, সেই পথ হইতে সরিবার কারণ এবং উপায়, কোনওটিই নাই।
অর্থমন্ত্রীর কথাটি খানিক বিশ্লেষণ করা ভাল। প্রথমত, বেশ কিছু দিন নিয়ন্ত্রণে থাকিবার পর পাইকারি সূচকের নিরিখে মূল্যস্ফীতির হার ফের সাত শতাংশের সীমা পার হইয়াছে। হারটি অর্থনীতির পক্ষে স্বাস্থ্যকর নহে। দ্বিতীয়ত, কেবলমাত্র খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণেই এই মূল্যস্ফীতি নহে— পরিভাষায় যাহাকে ‘কোর ইনফ্লেশন’ বলা হইয়া থাকে, তাহার হারও বাড়িতেছে। অতএব, সতর্ক থাকা প্রয়োজন। কিন্তু, এই দ্বিতীয় প্রসঙ্গটিকে আপাতত যদি বাদও রাখা যায়, তবুও অর্থমন্ত্রী নিজের যুক্তির ফাঁদেই আটকা পড়িবেন। তিনি বলিয়াছেন, খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের জন্য উৎপাদন বাড়াইতে হইবে, তাহার জন্য বিনিয়োগ প্রয়োজন এবং তাহার জন্য বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ (অর্থাৎ, কম সুদের হার) চাই। কিন্তু মন্ত্রিবর যাহা বলেন নাই, তাহা হইল, ভারতের বর্তমান খাদ্যসংকটের কারণ উৎপাদনের অভাব নহে পশ্চিমবঙ্গের হিমঘরগুলি সাক্ষ্য দিবে— যথার্থ জোগান-শৃঙ্খলের অভাবেই এই বিপদ হইয়াছে। এই অভাবটি কোন বিনিয়োগের মুখ চাহিয়া ছিল?
আরও দুইটি চিন্তার বিষয় আছে।
প্রথম, ডলারের দাম ফের ঊর্ধ্বমুখী হইবার সম্ভাবনা উড়াইয়া দেওয়া যাইতেছে না।
দ্বিতীয়, ভারতের মূল্যস্ফীতির হার আন্তর্জাতিক স্তরে তাহার সমগোত্রীয় দেশগুলির তুলনায় গত কয়েক বৎসর যাবৎ উদ্বেগজনক রকম বেশি। দুইটি বিষয়ই রাজনকে তাঁহার সুদের হারের নীতিতে অবিচল থাকিতে প্ররোচিত করিবে। তবে, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি লইয়া অন্তত এই মুহূর্তে প্রভূত দুশ্চিন্তা না করিলেও চলিবে। বেন বার্নানকের সম্ভাব্য উত্তরসূরি জ্যানেট ওয়েলেন ইঙ্গিত দিয়াছেন, তাঁহার ব্যয়সংকোচের পথে হাঁটিবার বিশেষ তাড়া নাই। অতএব, এখনই বিদেশি লগ্নির মহানিষ্ক্রমণও ঘটিতেছে না। বস্তুত, এই আর্থিক বৎসরে ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিন্স, তাইল্যান্ড, ভিয়েতনামের ন্যায় দেশগুলির তুলনায় ভারতে অনেক বেশি পরিমাণ বিদেশি পুঁজি আসিয়াছে। সেই পুঁজি যাহাতে ভারতেই থাকে, তাহা দেখিবার দায় একা রাজনের নহে, চিদম্বরমেরও। নির্বাচনী দামামার মধ্যে সেই কাজটি তিনি কতটা পারেন, তাহাই এখন দেখিবার বিষয়। |