|
|
|
|
কলকাতায় রাজশেখর-পুত্র |
জগনকে নিয়ে এক ঢিলে ৩ বার্তা মমতার
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
তাঁর কেন্দ্রীয় সরকার তথা কংগ্রেস-বিরোধী সাম্প্রতিক অবস্থানকেই আরও ধারালো করে রাজ্য ভাগের বিরুদ্ধে ফের জোর সওয়াল করলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অন্ধ্রপ্রদেশের ওয়াইএসআর কংগ্রেসের নেতা জগন্মোহন রেড্ডিকে পাশে নিয়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে রাজ্য ভাগের সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য তুলোধোনা করলেন কেন্দ্রকে। সেই সঙ্গে জগনকে আশ্বাস দিলেন, সংসদের আসন্ন অধিবেশনে তেলঙ্গানা তৈরির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সরব হবে তৃণমূল। যার মধ্যে লোকসভা ভোটের আগে-পরে সম্ভাব্য সমীকরণের ছবিই ধরা পড়ছে।
অন্ধ্র-ভাগের বিপক্ষে রাজনৈতিক সমর্থন জোটাতে বুধবার কলকাতায় এসেছিলেন সে রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ওয়াই এস রাজশেখর রেড্ডির ছেলে, সাংসদ জগন। সঙ্গে ছিলেন তাঁর দলের কয়েক জন প্রাক্তন ও বর্তমান সাংসদ। ওয়াইএসআর কংগ্রেসের প্রতিনিধিদল এবং জগনের সঙ্গে এ দিন দুপুরে নবান্নে আলাদা করে কথা বলেন মুখ্যমন্ত্রী। তেলঙ্গানার বিষয়টিই বৈঠকের উপলক্ষ হলেও এই সাক্ষাৎ থেকে তৃণমূল নেত্রী এক ঢিলে তিন পাখি মারার চেষ্টা করেছেন বলেই রাজনৈতিক শিবিরের অভিমত। |
 |
নবান্নে জগন্মোহন রেড্ডির সঙ্গে বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
সঙ্গে ডেরেক ও’ব্রায়েন। বুধবার। ছবি: প্রদীপ আদক। |
প্রথমত, সংশ্লিষ্ট রাজ্য এবং সেখানকার মানুষের মনোভাব যাচাই না-করে একতরফা ভাবে রাজ্য ভাগের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় কেন্দ্রকে তীব্র আক্রমণ করতে পেরেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর ইদানীং কালের কেন্দ্র-বিরোধী লড়াইয়ের সঙ্গে যা সামঞ্জস্যপূর্ণ। দ্বিতীয়ত, তেলঙ্গানার বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থানের কথা দৃঢ় ভাবে জানিয়ে দিয়ে দার্জিলিঙে বিমল গুরুঙ্গদের ফের বার্তা দিতে পেরেছেন যে, রাজ্যের অখণ্ডতা বজায় রাখাই পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অগ্রাধিকার। এবং তৃতীয়ত, জগনকে পাশে পাওয়ায় লোকসভা ভোটের আগে কংগ্রেস ও বিজেপি-কে বাদ দিয়ে আঞ্চলিক দলগুলিকে একজোট করার প্রয়াসও গতি পেয়েছে।
বস্তুত, জগনের সঙ্গে বৈঠকের কিছু ক্ষণ আগেই এ দিন বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রী মন্তব্য করেছেন, আগামী লোকসভা ভোটের পরে কেন্দ্রে আঞ্চলিক দলগুলিই রাজত্ব করবে। খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রশ্নে কেন্দ্রকে দোষারোপ করতে গিয়েই কংগ্রেস বিধায়কদের লক্ষ করে তাঁর উক্তি ছিল, “আপনারা যা হাল করেছেন, তাতে জনগণ আপনাদের ‘জিরো’ করে ছেড়ে দেবে! আপনারাও থাকবেন না, সিপিএম-ও থাকবে না, বিজেপি-ও থাকবে না। কেন্দ্রে রাজত্ব করবে আঞ্চলিক দলগুলি।” যদিও তার প্রতিক্রিয়ায় কংগ্রেস বিধায়ক মানস ভুঁইয়া মন্তব্য করেছেন, “মানুষের কষ্টের কথা বলতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী লোকসভা ভোটের নির্বাচনী বক্তৃতা দিয়েছেন বিধানসভায়!” প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্যও কটাক্ষ করেছেন, “এমন অবাস্তব কথা কোনও সুস্থ মানুষের পক্ষে বলা সম্ভব নয়!” কংগ্রেসের তরফে তীব্র প্রতিক্রিয়া হলেও আঞ্চলিক দলগুলিকে সঙ্গে নিয়ে এগোনোর পরিকল্পনায় তৃণমূল নেত্রী অবশ্য অবিচল।
মুখ্যমন্ত্রী বিধানসভাতেই আরও বলেছেন, রাজনীতিতে চিরস্থায়ী শত্রু-মিত্র বলে কিছু হয় না। শত্রুর শত্রু মানে তাঁর বন্ধু, এই তত্ত্বেও তিনি বিশ্বাস করেন না। তৃণমূল সূত্রের ব্যাখ্যা, কংগ্রেসের বিরোধিতা করা মানেই যে বিজেপি-র দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়ানো নয়, এই বার্তাই দিতে চেয়েছেন মমতা।
জগনের সঙ্গে বৈঠক করে যে বার্তাকে আরও স্পষ্ট করেছেন তৃণমূল নেত্রী। পশ্চিমবঙ্গ থেকে এ বার একা লড়েই লোকসভায় যথাসম্ভব বেশি আসন জেতার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী তৃণমূল। আবার তেলঙ্গানা বাদে অন্ধ্রের বাকি অংশে বেশির ভাগ আসন তাঁরা জিতবেন বলে জগনদের আশা। সে ক্ষেত্রে এই দুই শক্তি পাশাপাশি থাকলে ভোট-পরবর্তী পরিস্থিতিতে সমীকরণ গড়তে সুবিধা হবে। মমতা অবশ্য বলেছেন, “আমরা কোনও যুক্তরাষ্ট্রীয় ফ্রন্ট, দ্বিতীয়, তৃতীয় বা চতুর্থ ফ্রন্ট গড়ছি না! আমরা ইউনাইটেড ইন্ডিয়া ফ্রন্টের পক্ষে!”
জগনের রাজনৈতিক অনভিজ্ঞতার কথা মাথায় রেখে মমতা তাঁকে একেবারে ‘দিদির মতো করে’ কিছু পরামর্শও দিয়েছেন বলে তৃণমূল সূত্রের খবর। উপহার পাঠিয়েছেন জগন ও তাঁর মা বিজয়াম্মার জন্য। জগনদের পাশে যে তাঁরা আছেন, তা বোঝানোর জন্যই সংসদেও বিষয়টি নিয়ে সরব হওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী। রাজ্যসভার দলনেতা মুকুল রায় এবং মুখ্য সচেতক ডেরেক ও’ব্রায়েনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে গোটা বিষয়টি সম্পর্কে দলের সব সাংসদকে অবহিত করার জন্য।
নবান্নে জগনের সঙ্গে বৈঠকের পরে এ দিন মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “কোনও রাজ্যের এলাকা বড় হতে পারে, রাজ্য বড় হতে পারে। কাজের সুবিধার জন্য, রাজ্যের উন্নতির জন্য বিশেষ প্যাকেজ দেওয়া যেতে পারে। যেমন দার্জিলিঙের জন্য আমরা দিয়েছি। কিন্তু রাজ্য ভাগে আমার মত নেই।” মমতার আরও বক্তব্য, “ছত্তীসগঢ়, উত্তরাখণ্ড, ঝাড়খণ্ড রাজ্য গঠনের সময় সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয়েছিল। তেলঙ্গানার বেলায় তা হয়নি।” জগনও বলেন, “সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতা নিয়ে তবেই রাজ্য ভাগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত। কেন্দ্র কী করছে, তা আপনারা বোঝার চেষ্টা করুন। কেন্দ্র তার ইচ্ছামতো কোনও রাজ্যকে ভেঙে দিতেই পারে। কিন্তু তা করার আগে সংবিধানের ৩ নম্বর অনুচ্ছেদের (নতুন রাজ্য সৃষ্টি বা কোনও রাজ্যের সীমানা পুনর্বিন্যাস সংক্রান্ত ধারা) সংশোধন দরকার।”
শ্রীকৃষ্ণ কমিশন বা অতীতের সারকারিয়া কমিশনের মতামত খতিয়ে না-দেখে কেন্দ্রীয় সরকার কেন হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর কথায়, “সমীক্ষা করা হোক। হঠাৎ করে আমি চাই বলে করে দিলাম, এটা ঠিক নয়! জনগণের আস্থা অর্জন না-করে কোনও কিছু করা ঠিক নয়। নির্বাচনের আগে এই ভাবে রাজ্য ভাঙা হলে তা রাজনৈতিক ফায়দার জন্যই হবে।”
রাজ্য ভাগের বিপক্ষে মত গড়তে জগনরা সব দলের কাছেই যাচ্ছেন। কলকাতা আসার আগে সিপিএমের প্রকাশ কারাটদের সঙ্গে কথা বলেছেন, এর পরে মুলায়ম সিংহের সমাজবাদী পার্টির কাছেও যাবেন। মমতা নিজেও এ দিন জানিয়েছেন, সমর্থন পাওয়ার জন্য সকলের দ্বারস্থ হচ্ছেন জগন। মমতার কথায়, “জগন্মোহনদের প্রতি আমাদের সমর্থন সব সময় রয়েছে। আমরা অভিন্ন ভারতের পক্ষে।” জগনদের মতো ছোট, আঞ্চলিক শক্তিকে ধরেই ভবিষ্যতের ঘুঁটি সাজাতে চাইছেন তৃণমূল নেত্রী। |
|
|
 |
|
|