ফিসফিস করে এক জন বলল, ওটা নরওয়ে চেকার। পাশ থেকে আর এক জনের গলা, স্ট্যাভেঞ্জারে তোমার জন্য দারুণ জিনিস রেখেছি।
বাইরের জগতের কেউই এই কথাগুলোর মাথামুণ্ডু বুঝতে পারবে না। কিন্তু ওঁরা বুঝতেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে বাকিংহামশায়ারে ব্লেচলি পার্কে বসে অসংখ্য মহিলা এই সব দুর্বোধ্য কোডের আড়াল থেকে উদ্ধার করতেন গোয়েন্দা তথ্য। নাৎসি জেনারেলদের মধ্যে যে সব গোপন তথ্য আদানপ্রদান হত, তা খুঁজে বার করার দায়িত্ব ছিল ব্রিটেনের এই মহিলাদের উপরে। আর এর জন্য অভিজ্ঞ নয়, ব্রিটেন বেছে নিত কমবয়সী মেয়েদের। এ দলে ছিল ১৮ বছরের অনেক মেয়েই।
কী ভাবে বেছে নেওয়া হত ওদের? একটি ব্রিটিশ দৈনিকের কঠিন ধাঁধা যারা ১২ মিনিটেরও কম সময়ে সমাধান করতে পারতেন, তাঁদের দর ছিল বেশি। নিজেদের শান্ত শহরতলি থেকে তাঁদের এক রকম তুলে নিয়ে আসা হত ব্লেচলি পার্কে। অনেকেই জানতেন না, তাঁরা ঠিক কী করছেন।
প্রাক্তন গোয়েন্দা কর্তা ফ্রেডরিক উইন্টারবথামের লেখা ‘দি আল্ট্রা সিক্রেট’ নামে একটি বইয়ের সুবাদে প্রকাশ্যে এসেছে ব্লেচলি পার্কের কথা। তার আগে পর্যন্ত গোপনীয়তায় মোড়া ছিল ব্রিটেনের এই প্রমীলা বাহিনীর কথা। ১৯৭৪-এ যার হদিশ দেন উইন্টারবথাম। তিনি নিজেও পরে ‘আল্ট্রা ইনটেলিজেন্স’-এ (এই নামেই ডাকা হত ওই দলটিকে) যোগ দেন।
মার্গারেট বুলেন। বয়স এখন ৮৮। ১৯৪২ সালে আল্ট্রা ইনটেলিজেন্স-এ যোগ দিয়ে যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ পর্যন্ত ওই দলে ছিলেন। তাঁর বয়ান থেকে জানা যায়, কী ভাবে তাঁরা কাজ করতেন সেখানে। বুলেনের কথায়, “যুদ্ধের মাঝখানেই হঠাৎ এক দিন ফোন এল। আমাকে বলা হল, যুদ্ধে নিজের দেশের পাশে দাঁড়াও। তার পরে বিদেশ মন্ত্রকের একটা চিঠিতে ইন্টারভিউয়ের কথা বলা ছিল। দু’সপ্তাহ পরে জানলাম ব্লেচলি যেতে হবে।” একই রকম অভিজ্ঞতা ৯০ ছুঁইছুঁই বেকি ওয়েবের। ১৮ বছর বয়সেই যোগ দিয়েছিলেন আল্ট্রা ইনটেলিজেন্স-এ। বলছেন, “কাজ শুরুর আগে গোপনীয়তা রক্ষা আইনে সই করতে হত আমাদের। অত কম বয়সে সেটা যে কী, তা বোঝার ক্ষমতা ছিল না। সব মিলিয়ে বেশ ভয় ভয়ই করত।” বেকি জানিয়েছেন, তাঁরা জানতেন যে, যা করানো হচ্ছে, সেটা আদ্যোপান্ত মেনে চলা ছাড়া আর উপায় নেই।
বুলেন যেমন বলছেন, “আসলে কী হচ্ছে, তা জানতাম না। শুনতে অদ্ভুত হলেও কথাটা সত্যি।” তাঁকে এক দম্পতির সঙ্গে থাকতে বলা হয়েছিল বলে জানান বুলেন। তাঁর কথায়, “ওই দম্পতি যুদ্ধের জন্য আমাকে তাঁদের কাছে রেখেছিলেন। কিন্তু আমি ওখানে কী করছি, তাঁরা কোনও দিন জানতে চাননি। ছোট্ট গ্রামে এক অষ্টাদশী কেন হাজির হল, তা নিয়ে মাথাব্যথা ছিল না কারও।” বুলেন জানিয়েছেন, “যুদ্ধ শেষ হওয়ার তিন দশক পরে ব্লেচলি পার্কে গিয়ে জানলাম আমি এখানে কাজ করতাম! এই কাজ করতাম!”
নাৎসি জমানার পতনের পরে এই প্রমীলা বাহিনীর অনেকেই বাড়ি ফিরে যান। কেউ কেউ সেনায় যোগ দেন। কারণ গোপনীয়তা রক্ষা করার কাজ ওঁরা ভাল পারতেন। |