গোপীগীতে রাইয়ের মানভঞ্জন
প্রশান্ত পাল
যোধ্যা পাহাড়ের পাদদেশে গ্রামটির নাম বেগুনকোদর। পুরুলিয়া শহরের রাসের ইতিহাস এই গ্রামের রাজবাড়ির সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে। শ’দুয়েক বছর আগে বেগুনকোদর রাজবাড়িতে রাসের সূচনা। তার অনেক পরে পুরুলিয়া শহরের কিছু মানুষ অনুপ্রাণিত হয়ে জেলা-সদরে রাসের আয়োজন করেন। আনন্দ-উৎসবে যাতে ব্যাঘাত না ঘটে, তাই এক জায়গায় শেষ হওয়ার পর অন্য জায়গায় শুরু হয় রাস। আজও প্রথা মেনে দু’জায়গাতেই রাস উৎসব হয়।
বেগুনকোদরে এ বছরের রাসের সূচনা।
বেগুনকোদরে রাস উৎসব শুরু হয় ১৭৯৭ খ্রিস্টাব্দে রাজা রতন সিংহের সময়। উৎসবের সূচনা হয়েছিল কী ভাবে? নবদ্বীপের আচার্য রাধাবিনোদ ঠাকুর গোস্বামী সেই ইতিহাসের কথা শোনালেন। চৈতন্য মহাপ্রভুর পার্ষদ ধনঞ্জয় পণ্ডিতের চতুর্থ পুরুষ স্বরূপচাঁদ ঠাকুর থাকতেন বীরভূমের বোলপুরের কাছের একটি গ্রাম জলন্দিতে। রাজা রতন সিংহ সেই গ্রামে গিয়ে স্বরূপচাঁদের শিষ্য হয়ে বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষা নিলেন। এর পর ঠাকুর তাঁকে নিয়ে বৃন্দাবনে যান। সেখান থেকে ফেরার সময় একটি রাধাগোপীনাথের বিগ্রহ এনে রাজবাড়িতে প্রতিষ্ঠা করলেন রতন সিংহ। মন্দিরের দায়িত্ব তো বটেই স্বরূপচাঁদকে দেওয়া হল রাজগুরুর অভিধা। এর পর রাধাগোবিন্দকে ঘিরে রাজবাড়িতে আয়োজিত হতে থাকে একের পর এক উৎসব। ঝুলন, দোলের পাশাপাশি এক দিন রাস উৎসবেরও সূচনা হয়।
ঝালদার বেগুনকোদরের এই রাস এখন কী ভাবে আয়োজিত হয়?

যে হেতু ঐতিহ্যের ছোঁয়া রয়েছে, তাই রাজতন্ত্র বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার পর আজও সমান গুরুত্বের সঙ্গে এখানকার রাস অনুষ্ঠিত হয়। রাত্রে পূজারি রাধারানির বিগ্রহ বংশীবটের কোটরে লুকিয়ে রাখেন। তার পর গোবিন্দের বিগ্রহ কোলে তিনি সেই বিগ্রহ খুঁজতে বেরোন। খুঁজে পাওয়ার পর দেখা যায় রাধারানি যেন একটু ঘুরে রয়েছেন রাইয়ের মান হয়েছে। গোপীনাথ কাছে এলেও মুখ ফিরিয়ে থাকেন রাধা। শেষে জয়দেবের গীতগোবিন্দ থেকে পদ গাওয়া হলে তাঁর মান ভাঙে। গোবিন্দ তখন রাইয়ের মুখে তাম্বুল তুলে দেন। যুগল মিলনের পর দু’টি বিগ্রহকেই রাসমঞ্চে নিয়ে আসা হয়। প্রভুপাদ প্রফুল্লকমল গোস্বামীর আমল থেকে এই লুকোচুরি খেলার সময় এক ধরনের গান গাওয়া হয়, যার নাম গোপীগীত। খেলা চলে অনেক রাত অবধি। ভক্তরা তখন আনন্দে নাচতে থাকেন। ভোরবেলার দিকে সেবার উদ্দেশ্যে দু’টি বিগ্রহকেই ফের মন্দিরে নিয়ে আসা হয়। রাস উৎসবের পাঁচ দিনই এই প্রথা মেনে অনুষ্ঠান হয় বেগুনকোদরে। স্থানীয় বাসিন্দাদের বিশ্বাস, এ ক’দিন রাধা-গোবিন্দ রাত জাগেন। বেগুনকোদর গ্রামের বাসিন্দা পবিত্র দৈবজ্ঞ জানিয়েছেন, “আজও একাদশী থেকে পূর্ণিমা অবধি টানা পাঁচ দিন এখানে রাস উৎসব হয়।”
কিন্তু বেগুনকোদর রাজবাড়ির এই রাস পুরুলিয়া শহরে কী ভাবে প্রভাব ফেলল?
পুরুলিয়া শহরে রাস-চিত্র
পুরুলিয়া রাস কমিটির কাযর্করী সভাপতি গোবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের কথায়, সে সময় পুরুলিয়া শহরে কোনও মেলা বা উৎসব ছিল না। ধীবর সম্প্রদায়ের কয়েক জন মানুষ এখান থেকে বেগুনকোদরে গিয়েছিলেন রাস দেখতে। সেখানে গিয়ে তাঁরা এতই মুগ্ধ হন, যে ফিরে এসে পুরুলিয়া শহরে রাস উৎসব আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেন। যে হেতু বেগুনকোদরে পাঁচ দিন রাস চলে তাই ঠিক করা হয়,ওখানকার রাস শেষ হওয়ার পর পুরুলিয়ায় রাস হবে। সেই প্রথা মেনে আজও পুরুলিয়া শহরে রাসমেলা অনুষ্ঠিত হয়। মূল রাস এবং ভাঙা রাস মিলিয়ে মেলা থাকে সপ্তাহ তিনেক। শহরের বাসিন্দা কবি নির্মল হালদার জানিয়েছেন, “আগে এলাকার বাসিন্দাদের কাছে রাসমেলাই ছিল বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম। শুধু শহরই নয়, বিভিন্ন গ্রাম থেকে দলে দলে মানুষ ভিড় জমাতেন। এখন বিনোদনের অনেক উপাদানই বছরভর মানুষ হাতের কাছে পাচ্ছেন। কাজেই মেলার আকর্ষণ খানিকটা হলেও কমেছে। তবে এখনও মেলার টানে বহু মানুষ আসেন। মিশে যান আনন্দের ভিড়ে।”

এ ছাড়া সাঁতুড়ি ব্লকের মুরাডিতেও রাইবেশ এস্টেটের রাস উৎসব আজও প্রথা মেনে ৯৩১ বঙ্গাব্দ থেকে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, পঞ্চকোট রাজবংশের পৃষ্ঠপোষকতায় এই রাস শুরু হয়েছিল।
ছবি: সুজিত মাহাতো।




 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.