নবদ্বীপ
পুরনো রাসের সেই মারামারি এখন নেই
কালিদাস রায়চৌধুরী

বদ্বীপের রাস আমি প্রথম দেখি ১৯৪২-এ। বিয়াল্লিশের আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ার কারণে আমার ব্রিটিশ ভক্ত জমিদার ঠাকুরদা আমাকে সটান দেশের বাড়ি থেকে নবদ্বীপে পাঠিয়ে দেন। তখন আমার তরুণ বয়স। বাংলাদেশের ফরিদপুর ধলপুরের ভিটে ছেড়ে সেই প্রথম কোনও বড় শহরে থাকা। স্বাভাবিক ভাবেই সেই সময়ের নিরিখে নবদ্বীপ বড় শহর। তার প্রধান উত্সব রাস দেখে কার্যত ‘থ’ হয়ে গিয়েছিলাম। কাকে বলে উত্সব সেই প্রথম দেখলাম। প্রথম বারের দেখা তরুণ বয়সের সেই রাসের ঘোর আজও যেন চোখে লেগে আছে।

সব থেকে যেটা বেশি মনে আছে তা হল আড়ং বা রাসের শোভাযাত্রার দিনে ব্যাপক মারামারি। সারা বছরের রাগ-ঝগড়া সব জমানো থাকত রাসের জন্য। তার পর আড়ং-এর শোভাযাত্রা বেরিয়ে কোনও না কোনও অছিলায় শুরু হয়ে যেত মারামারি। এ জন্য সে সময় প্রতিমার পিছনে লুকানো থাকত এক ধরনের ছোট বাঁশের লাঠি। যার নাম ছিল ‘খেটে’। মদ খেয়ে উন্মত্ত রাসুরের দল এই খেটে নিয়েই রক্তাক্ত করতেন রাস। তবে এখন আর সে দিন নেই। সেই দিক থেকে রাস অনেক বদলে গেছে। আর এই বদলের পিছনে প্রথম যিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি সেকালের নবদ্বীপের স্বনামধন্য পুরপ্রধান বায়বাহাদুর পূর্ণচন্দ্র বাগচি।

সেটা ১৯৪৮-এর কথা। স্বাধীনতার পর প্রথম রাস। পূর্ণবাবু ঠিক করেছিলেন আড়ং-এর এই মারামারি বন্ধ করতে হবে। আর সেটা করতে গেলে নিজে আড়ং-এর শোভাযাত্রায় বের হতে হবে। মনে আছে, সে বার আড়ং-এর দিন দুপুরে ঢাক্কাপাড়ের কোঁচানো ধুতি লুটিয়ে রাস করতে নামলেন রায়বাহাদুর স্বয়ং। পাড়ার প্রতিমার সঙ্গে রীতিমতো নাচতে নাচতে চলেছেন পূর্ণচন্দ্র বাগচি। আর হাতে একটা ধবধবে সাদা তোয়ালে। দু’হাতে সেই সাদা তোয়ালে মাথার উপর তুলে অদ্ভুত এক নাচ। আর শহরের সমস্ত বারোয়ারির উদ্যোক্তাদের অনুরোধ করছেন, ‘এ বার থেকে রাসে আর শক্ত লাঠি নয়, নরম তোয়ালের দিন শুরু হোক।” বেশ মনে আছে, চেয়ারম্যানকে ওই ভাবে রাস্তায় দেখে সে বার অন্তত কোনও গোলমাল হয়নি।

৯০ বছর বয়স অবধি রাসের অনেক কিছু বদল দেখলাম। সে দিনের সঙ্গে আজকের রাসের দিনরাতের ফারাক। আক্ষরিক অর্থেই তখন রাসের সব কিছুই হত দিনের বেলায়। পুজো-ভাসান সবই দিনে দিনে। প্রতিমার উচ্চতা কেবল আজকের মতোই ছিল। মণ্ডপ বলতে চারখানা বাঁশের খুঁটির ওপর কোনও রকমে ত্রিপল বা চট চাপানো। আর রাতে বেশির ভাগ জায়গায় হ্যাজাক বা ডেলাইটের আলো। সামান্য দু’-এক জায়গায় টিমটিমে বাল্বের আলো জ্বলত। বেশ কিছু প্রতিমা বেয়ারাদের কাঁধে বিসর্জনে যেত। ১০০-১৫০ জন বেয়ারা থাকত প্রতিমার উচ্চতা অনুযায়ী। পরের দিকে গাড়ির চল হল। তখন দু’জোড়া গোরুর গাড়ির চাকা বাঁশ দিয়ে জুড়ে তার উপর প্রতিমা বাসানো হত। মানুষ টানত সেই প্রতিমাবাহী গাড়ি। অনেকটা রথের মতো ব্যাপার। আর এখন তো বল বিয়ারিংয়ের আধুনিক গাড়িতে বড় বড় প্রতিমা বন বন করে ঘুরছে।

রাসে সব বদলই ভাল হয়েছে। কেবল শব্দের দাপট ছাড়া। এখনকার ‘তাসা’র বাজনায় কোনও মধুরতা নেই। সে কালের ঢোল-সানাই ডগরের বাজনায় রাস ছিল অনেক সুরেলা। পয়সাওয়ালা বারোয়ারি ‘গড়ের বাদ্যি’ বা ইংলিশ ব্যান্ড। আমরা ব্যান্ডের নাম শুনে বাজনা শুনতে যেতাম। এখন রাসের শব্দের মারাত্মক চাপটা নিতে পারি না। শরীর খারাপ লাগে। তবে রাস দেখতে সে কালে প্রচুর মানুষ নবদ্বীপে আসতেন। পথের ধারে লোকের বাড়ির খোলা বারান্দায় দল বেঁধে রাত কাটিয়ে পর দিন গঙ্গাস্নান করে মহাপ্রভুকে প্রণাম করে গঙ্গা পার হয়ে চলে যেতেন শান্তিপুর। সেখানে তখন শুরু হয়েছে ভাঙারাস।
ছবি: দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়।




 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.