|
|
|
|
|
নবদ্বীপের রাস— উত্স ও ইতিহাস |
দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় |
কার্তিক পূর্ণিমার রাত বৈষ্ণবদের বড় প্রিয়। এ রাতেই তাদের প্রাণের উৎসব রাস উদযাপিত হয়। তাই ভজনকুটিরের নিকোনো উঠোনে আলপনা, উঠোনের পূর্ব কোণে টাঙানো ছোট্ট একখানি চাঁদোয়া। তার নীচেই রাধাকৃষ্ণের যুগল বিগ্রহ। বড় মায়াময় সে মূর্তি। উঠোনের এক কোণে মঞ্জরীভরা তুলসী গাছের ঝাড়। কার্তিকের জ্যোৎস্নার দুধ-সাদা আলোয় আটপৌরে ভজনপ্রেমের চেনা পরিবেশ কেমন যেন অপার্থিব সুন্দর হয়ে ওঠে। কাঠের ছোট সিংহাসনে বসানো যুগলবিগ্রহের চার পাশে গোল করে সাজানো অষ্টসখীর মূর্তি। পরনে জমকালো পোশাক। সামনে ফরাস পাতা। তাতে সাজানো মৃদঙ্গ, মন্দিরা, হারমোনিয়াম, করতাল এবং আড়বাঁশি। সুগন্ধী ধূপ, আতর এবং ফুলের গন্ধে ম ম করে চারপাশ।
সন্ধ্যারতি শেষ। কপাল থেকে নাক পর্যন্ত তিলকপরা এক মাঝবয়েসি বৈষ্ণবভক্ত বিগ্রহের দিকে হাতজোড় করে প্রণাম করে তুলে নিলেন আড়বাঁশিটি। গভীর শান্ত চোখ দুটি বুজে আলতো ফুঁয়ে ধরলেন আলাপ। রাগ কেদার। বাঁশির সুরে ভজনকুটিরের উঠোনে ক্রমশ বুঁদ হয়ে উঠেছে রাস পূর্ণিমার রাত। ভিড় বাড়ছে আসরে। এ বার বাঁশির সঙ্গে ‘নিখুঁত কণ্ঠ’ মিলিয়ে বৈষ্ণবী গেয়ে উঠলেন মহাজনপদ—
বলয়া নূপুর মণি বাজয়ে কিঙ্কিণী
রাস রসে রতিরণে কী মধুর শুনি
জোড়া মৃদঙ্গ বেজে উঠল ‘ধ্রুব তালে’। নবদ্বীপের বৈষ্ণব ভজনকুটির বা আখড়াগুলিতে এ ভাবেই পালিত হয় রাস। |

রাসে শক্তির আরাধনা |
বলা হয় ‘রস’ থেকেই রাস। রস অর্থে সার, নির্যাস, আনন্দ, হ্লাদ, অমৃত ও ব্রহ্ম বোঝায়। ‘তৈত্তিরীয়’ উপনিষদে (২/৭) রস সম্পর্কে বলা হয়েছে “রসো বৈ সঃ। অর্থাৎ ব্রহ্ম রস ছাড়া আর কিছুই নন। বৈষ্ণব দর্শনে এই রস বলতে মধুর রসকেই বোঝানো হয়েছে। আর পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ হলেন মধুর রসের ঘনীভূত আধার। তাঁকে ঘিরেই রাস। রাস কথাটির আভিধানিক অর্থ হল নারী-পুরুষের হাত ধরাধরি করে মণ্ডলাকারে নৃত্য। যাকে বলা হয় ‘হল্লীবক” নৃত্য। কিন্তু বৈষ্ণবদের কাছে রাস কথাটির ভিন্ন অর্থ বহন করে। শ্রীকৃষ্ণ শারদপূর্ণিমার রাতে বৃন্দাবনের যমুনাতটে গোপিনীদের আহ্বান করেন এবং তাদের অহং বর্জিত বিশ্বাসভক্তি ভাবে তুষ্ট হয়ে সঙ্গদান করেন। তাই বৈষ্ণবদের কাছে রাস আসলে ভক্ত এবং ভগবানের মিলন উৎসব। এক অসামান্য আনন্দ উৎসব।
এহ বাহ্য। বৈষ্ণবদর্শনে রাসের যে ব্যাখ্যাই থাকুক না কেন, বৈষ্ণব আখড়ায় যে ভাবেই রাস পালিত হোক না কেন, শহর নবদ্বীপ, চৈতন্যজন্মভূমি নবদ্বীপে রাসের চেহারা ঠিক এর ‘বিপরীত’। পূর্ণিমার ভরা রাতে, বিশুদ্ধ তন্ত্রমতে শতাধিক শক্তিমূর্তির সাড়ম্বর পুজো, সঙ্গে আদ্যন্ত তামসিকতায় ভরা এক দামাল উৎসবের উদযাপন— সংক্ষেপে এটই হল নবদ্বীপের রাসের সংজ্ঞা। পূর্ণিমার রাতে দেড়শোর বেশি বিরাট বিরাট শক্তিমূর্তির পুজোর কারণে নবদ্বীপের রাসকে অনেকে ‘শাক্ত রাস’ বলেও অভিহিত করেন।
নবদ্বীপের রাসের উৎস ঠিক কবে, এর উত্তরে স্থানীয় ইতিহাসের গবেষক ও নবদ্বীপ পুরাতত্ত্ব পরিষদের সম্পাদক শান্তিরঞ্জন দেব জানান, নদিয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের রাজত্বকালে (১৭২৮-৮২) রাসের বাড়বাড়ন্ত শুরু হয়েছিল। রাজা হওয়ার পর থেকে ১৭৫০ পর্যন্ত কৃষ্ণচন্দ্র নানা সমস্যায় জর্জরিত থাকতেন। তার পর থেকে তিনি মঠমন্দির স্থাপন, মেলা উৎসবের সূচনা বা বহু জনকল্যাণমূলক কাজে মনোনিবেশন করেন। ১৭৫৩-৫৬-র মধ্যে তিনি জগদ্ধাত্রীপুজো, বারোদোলের সূচনা করেন। মনে করা হয় ওই একই সময়ে তিনি নবদ্বীপে বৈষ্ণবদের রাস উৎসবের খোলনলচে বদলে দেন। শান্তিরঞ্জনবাবু আরও বলেন, কৃষ্ণচন্দ্র নিজে ছিলেন শাক্ত। নদিয়া, অগ্রদ্বীপ, কুশদ্বীপ এবং উলা এই চারটি সমাজের সমাজপতি। তার রাজত্বে শুদ্ধাচারে শক্তিসাধনা হোক এটা তিনি মনেপ্রাণে চাইতেন। পাশাপাশি তিনি পছন্দ করতেন না চৈতন্যদেবকে মঠে-মন্দিরে পুজো করা হোক। তিনি বৈষ্ণববিদ্বেষী ছিলেন না, কিন্তু চৈতন্যদেবকে যাঁরা অবতার বলে পুজো করতেন তাঁদের তিনি ঘোর অপছন্দ করতেন। চৈতন্যদেবের অনুগামীরা বেদবিধি ও ব্রাহ্মণ্যস্মৃতি মানতেন, এটাও কৃষ্ণচন্দ্রের আপত্তির কারণ ছিল। তিনি রাসপূর্ণিমার রাতে নবদ্বীপে শক্তিমূর্তি পুজোয় উৎসাহ দেওয়া শুরু করেন। রাজানুগ্রহে অচিরেই সেই উৎসব ছাপিয়ে যায় বৈষ্ণবীয় রাসকে।
|
বিশালাকার মাতৃমূর্তি |
 |
 |
|
কৃষ্ণচন্দ্রের আগে নবদ্বীপের বৈষ্ণবীয় রাসের ছবিটা ছিল অন্য রকম। ১৫৩৩-এ চৈতন্যদেবের তিরোধানের একশো বছরের মধ্যে গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মে বহু গোষ্ঠীর আবির্ভাব হয়। নানা সম্প্রদায়, গোষ্ঠীর মধ্যে বিভেদ শেষ পর্যন্ত বিদ্বেষে পরিণত হয়। সে সময়ে সাধারণ মানুষকে বেশি করে আকৃষ্ট করার জন্য বৈষ্ণব মঠ-মন্দির-আখড়ায় নানা অনুষ্ঠান জাঁকজমক করে পালন করা শুরু হয়। তার মধ্যে রাস উৎসব অন্যতম। সে সময়ে রাসলীলার বিষয়ে পটুয়াদের দিয়ে বড় বড় পট আঁকিয়ে মঠে-মন্দিরে প্রদর্শন করা হত। তাই রাসপূর্ণিমার আর এক নাম ‘পট পূর্ণিমা’। আর ওপরে গরুর গাড়ির চাকার থেকেও বড় বড় কাঠের চাকা তৈরি করে তার মাঝখানে রাধাকৃষ্ণকে বসিয়ে চারপাশে অষ্টসখীর মূর্তি বসানো হত। আর ধীরে ধীরে সেই চাকাটি ঘোরানো হত। একে বলা হত ‘চক্ররাস’।
এ সময়ে নবদ্বীপে বৈষ্ণবদের থেকে সামাজিক ভাবে প্রতিপত্তি সম্পন্ন ছিলেন সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতেরা। স্মৃতি এবং নব্যন্যায়ের তাবড় তাবড় পণ্ডিতের বাস তখন নবদ্বীপে। তাদের অনেক ধনী শিষ্য ছিলেন। মহালয়ার সকালে পিতৃতর্পণ সেরে এই পণ্ডিতেরা নিজ নিজ যজমানের বাড়ি চলে যেতেন দুর্গাপুজো করতে। ফিরতেন দীপান্বিতার পর। বাড়ি ফেরার পর কার্তিকী পূর্ণিমার শুভ দিনে যে যার বাড়িতে ঘট স্থাপন করে নিজ নিজ ইষ্টদেবীর পুজো করতেন। কালী, শবশিবা, মুক্তকেশী প্রভৃতি দেবীর পুজো করতেন তাঁরা। পণ্ডিতমশাইদের বাড়ির ওই সব পুজোকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন মহল্লায় উৎসব লেগে যেত। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র এই পুজোগুলোকেই বেছে নিয়েছিলেন রাসের চরিত্র বদলানোর জন্য।
তিনি ঘোষণা করেন, যিনি ঘটের বদলে মাটির মূর্তি গড়ে পুজো করবেন তিনি রাজানুগ্রহ পাবেন। তাঁর এই ঘোষণায় প্রথম সাড়া দিয়েছিলেন ভারতবিখ্যাত নৈয়ায়িক শঙ্করনাথ তর্কবাগীশ। ইনি কৃষ্ণচন্দ্রের সভাপণ্ডিত ছিলেন। নবদ্বীপের দেয়ারা পাড়ায় তিনিই প্রথম আলোকনাথ কালীর মূর্তি নির্মাণ করে পুজো করেন। এটাই নবদ্বীপের রাসের প্রথম প্রতিমা। সময়টা ১৭৫২ থেকে ৫৬-র মধ্যবর্তী কোনও বছর। তার পরের বছরই শিতিকণ্ঠ বাচস্পতি নির্মাণ করেন ‘শবশিবা’ মূর্তি। সেই শুরু। |

নবমী পুজোর ভিড়
|
২০১৩-র রাসে নবদ্বীপের প্রতিমার সংখ্যা ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৩০০টি। আর এই সব প্রতিমার সুবিশাল উচ্চতাই নবদ্বীপের রাসের বিশেষত্ব।
তবে শুরু থেকেই নবদ্বীপের রাস প্রতিমার উচ্চতা আজকের মতো ২৫-৩০ ফুট ছিল না। জনজীবনকে স্তব্ধ করে, যাবতীয় নাগরিক পরিষেবা যেমন বিদ্যুৎ, টেলিফোন, কেবল টিভির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে রাসের পর দিন শোভাযাত্রায় বের হয় এই ৩০০ প্রতিমা। বিসর্জন তার পর দিন। সব মিলিয়ে রাস উৎসবকে ঘিরে জনজীবনে নেমে আসে ৪৮ থেকে ৫০ ঘণ্টার অন্ধকার। উদ্যোক্তাদের সাফ কথা, উচ্চতাই নবদ্বীপের রাসের প্রতিমার ঐতিহ্য। সুতরাং কোনও আপস সম্ভব নয়। অথচ, কৃষ্ণচন্দ্রের উৎসাহে রাসে মাটির প্রতিমা করে পুজো শুরুর সময় ৪-৫ ফুটের মতো উঁচু হত প্রতিমাগুলি। পরে কিছুটা উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়ে ৭-৮ ফুট হয়। কিন্তু আকাশছোঁয়া প্রতিমা নির্মাণের সূচনা হয়েছিল ১৮২৮-এ। আর সে প্রতিমার সঙ্গে রাসের কোনও সম্পর্ক ছিল না। তৎকালীন নদিয়ারাজ গিরীশচন্দ্রের দেওয়ান হরগোবিন্দ প্রামাণিক চৈত্রমাসের বাসন্তী পুজোর সময় ৩৬ ফুট উঁচু ‘হটহাটিকা’ বা ‘বাসন্তীমূর্তি’ পুজো করেন। তার পরের বছর থেকে রাসে প্রতিমার উচ্চতা বাড়তে শুরু করে।
ইতিমধ্যে নবদ্বীপে একটি-দুটি করে প্রতিমার সংখ্যাও বাড়তে শুরু করেছে। প্রথম দিকে রাজানুগ্রহে বাঁশের প্রতিমা গড়ে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা পুজো শুরু করলেও অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে জাতগত বা জীবিকাগত বারোয়ারি পোড়ামাতলায় কংসবণিকদের ‘শ্যামা’, চারিচারাপাড়ায় কর্মকারদের ‘ভদ্রাকালী’, তেব্বড়িপাড়ায় ‘ভয়’ বা মৎস্যজীবীদের শ্যামা, শ্রীবাসঅঙ্গন পাড়ায় খাড়ালদের বিন্ধ্যবাসিনী, মালঞ্চপাড়ায় ‘দাস’(মুচি)-দের শ্যামাপুজোর উদ্ভব এ ভাবেই।
উনবিংশ শতকের তিন-এর দশক থেকে শুরু হয় জাতপাতহীন বারোয়ারি। এখনকার তিনশোটি প্রতিমার মধ্যে বেশির ভাগই কোনও বারোয়ারি অথবা ক্লাবের পরিচালনায় হয়ে থাকে। এর মধ্যে প্রাচীন বারোয়ারি পুজোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য আমড়াতলার মহিষমর্দিনী, যোগনাথতলার গৌরাঙ্গিনী, পোড়ামাতলার চণ্ডী ও রণকালী, রামসীতাপাড়ার বামাকালী, ফাঁসিতলার কৃষ্ণকালী, কয়েতবেলতলার গজা, ব্যানার্জিপাড়ার দেবী গোষ্ঠ, তেঘরিপাড়ার নবদুর্গা, বুড়োশিবতলার বিন্ধ্যবাসিনী, বড়ালঘাটের ভুবনেশ্বরী প্রভৃতি। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে রাসের প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে শহরের বিভিন্ন বড় বড় ক্লাব। আর সঙ্গে সঙ্গে রাসের চরিত্রেও আসে আধুনিকতার ছোঁয়া। |
বিসর্জনের পথে... |
 |
 |
শোভাযাত্রা |
অপেক্ষারত |
|
রয়েল ক্লাব, টাউন ক্লাব, জনপ্রিয় ক্লাব, দি নিউ ক্লাব, শ্রীমন্দির ক্লাব, বড়ালঘাট স্পোর্টিং ক্লাব বা স্বাধীন ভারত ক্লাবের হাত ধরে প্রতিমা, মণ্ডপ, আলোকসজ্জা এবং বাজনায় বিপুল বৈচিত্র এসে পড়ে রাসে। সঙ্গে বাড়তে থাকে প্রতিমার রকমফেরও। শক্তিমূর্তি দিয়ে রাসের শুরু হলেও পরবর্তী কালে রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ, তন্ত্র, ভাগবত, মঙ্গলকাব্য প্রভৃতি থেকে বিষয় অবলম্বন করে প্রতিমা তৈরি করে পুজো শুরু হয়। এমনকী বিভিন্ন ক্যালেন্ডার ও প্রত্রিকায় প্রকাশিত কোনও ছবিকে মূর্তিরূপ দিয়ে রাসে পুজো করা হয়। এক দিনের রাস এখন অবশ্য তিন দিনের পরিপূর্ণ বিনোদনের প্যাকেজ। কলকাতার মণ্ডপ, চন্দননগরের আলো, বাছাই করা বাজনায় আজকের নবদ্বীপের রাস জমজমাট। শোভাযাত্রায় ছেলেদের সঙ্গে সমানে পাল্লা দিয়ে মেয়েদের অংশগ্রহণ রাসকে স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে।
খুব অল্প সময়ের মধ্যে কয়েকশো সুবিশাল প্রতিমা নির্মাণ করার কৌশল ও দক্ষতা স্থানীয় মৃৎশিল্পীদের এক অনন্য প্রতিষ্ঠার জায়গা দিয়েছে রাজ্যের মধ্যে। সব চেয়ে বড় কথা, কাছাকাছি ঘূর্ণি নদী থাকা সত্ত্বেও নবদ্বীপের নির্মাণ শৈলীতে তার কোনও প্রভাব পড়েনি। শুধু তাই নয়, এত বিচিত্র ধরনের প্রতিমা আর কোথাও একসঙ্গে এ ভাবে দেখা যায় না। তাই বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে রাস উৎসবে ভিড় বাড়ছে বিদেশিদেরও। সব মিলিয়ে নবদ্বীপের আজকের রাস নিঃসন্দেহে এক বিরল উৎসবে রূপান্তরিত হয়েছে। |
ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য |
|
 |
|
|
|
|
|
|
|
|
 |
|