রাস মণ্ডপের সামনে দাঁড়ালে এখনও স্পষ্ট কার্বাইডের গন্ধটা টের পাই। সেই কবে বাবার হাত ধরে রাস দেখতে যেতাম। তখন এত আলোর বাহার ছিল না। এলইডি-টুনি তো সে দিনকার শিশু, আমাদের ছোটবেলায় আলো বলতে ছিল কার্বাইড গ্যাসের বাতি। সেই বাতির ঝাড়েই আলোকিত মণ্ডপ। গোটা চত্বর জুড়ে ওই গ্যাসের গন্ধ একটা মাদকতার সৃষ্টি করত। মণ্ডপ সাজানো হতো দেবদারু-সহ অন্য সব বাহারি পাতা দিয়ে। আর থাকত লাল-নীল কাগজের মালা।
সময় বদলেছে। তার সঙ্গে পালটে গিয়েছে আমাদের ছোটবেলাটাও। কার্বাইডের আলো সরে গিয়ে তার জায়গা নিয়েছিল হ্যাজাক। আমরা তাকে ‘ডে লাইট’-এর আলো বলতাম। পাড়ার রায়বাড়িতে বড় করে রাস হতো। ওদের বাড়িতে প্রথম যে বার ‘ডে লাইট’-এর আলো এল, আমাদের সে কি আনন্দ! এত আলো আগে কখনও দেখিনি বলে উৎসাহের অন্ত ছিল না।
আমাদের সেই ছোটবেলায় প্রত্যেক বিগ্রহ-বাড়িতে সকাল থেকে কীর্তন এবং কবিগান হতো। আর রাতে নাটমন্দিরে যাত্রা। বিকেল থাকতেই আমরা একেবারে সামনে গিয়ে বসে থাকতাম। ধীরে ধীরে ভিড় জমত। উৎসাহের অন্য একটা কারণও ছিল। যাত্রার মহড়াকক্ষে আমাদের কাউকে ঢুকতে দেওয়া হতো না। জানলার ফাঁক দিয়ে লুকিয়ে দেখার চেষ্টা করতাম। আসলে ওই মহড়াকক্ষ ছিল আমাদের কাছে এক রহস্যময় ঘর। কেননা ওখানেই সারা বছর ধরে তিল তিল করে গড়ে উঠত রাধাকৃষ্ণ-সহ আমাদের স্বপ্নের সব চরিত্রেরা। যাত্রায় বিগ্রহ-বাড়ির সদস্যদের পাশাপাশি পাড়ার অন্যরাও ‘পাঠ’ করতেন। যিনি কৃষ্ণের ভূমিকায় অভিনয় করতেন, তাঁকে সারা বছর আমরা সবাই বেশ সম্ভ্রমের চোখে দেখতাম। এখন ভাবলে হাসি পায়, কিন্তু সেই বয়সে রাধাকে মঞ্চ থেকে নামার পর পাইচারি করতে করতে বিড়ি টানতে দেখে বেশ অবাক হতাম!
এ সবের ভিতর দিয়েই বড় হয়ে উঠলাম। আর একটু একটু করে পালটে গেল রাসও। এই বদলটা আমাদের চোখে সব সময় ধরা পড়েনি। তাই বুঝতে পারিনি বিগ্রহ-বাড়ির পাশাপাশি কখন যেন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে বারোয়ারি রাস। ম্যারাপ বাঁধা মণ্ডপ থেকে থিমের লড়াই— অনেকটা পথ। মানুষের মাথার ভিড়ে কবে যেন হারিয়ে গিয়েছে আমাদের সেই ছোটবেলার মশলামুড়ি, আলুকাবলি আর কাগজের চরকি। ভিড়ের মধ্যে দাঁড়ালে আজও সেই লোকটিকে দেখতে পাই। হাঁটুর উপরে ধুতি তোলা আদুল গায়ের সেই মানুষটা একটানা হেঁকে চলেছেন, ‘হাওয়াই মালাই’। সারাটা বছর আমরা এই ডাকটার অপেক্ষায় থাকতাম। |
শান্তিপুরের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ ভাঙা রাস। আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে যায় তার শোভাযাত্রা। বাড়ির বারান্দায় বসে এত বছর ধরে ভাঙা রাসকেও আস্তে আস্তে বদলে যেতে দেখলাম। মনে হয়, এই তো সে দিন, হাওদায় বসিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বিগ্রহ এবং রাইরাজাকে। পিছনে গরুরগাড়িতে একে একে বালক নাচ, সঙের দল, ময়ূরপঙ্খী গান আর শোভাযাত্রার দু’পাশে মাথার উপর বসানো কার্বাইড গ্যাসের বাতি। আরও পরে ডে লাইটের আলো। রাস্তাজুড়ে গোবরের ছড়াছড়ি। মহিলারা তার ভিতরেই রাইরাজাকে দেখে মাটিতে গড় হয়ে প্রণাম করছেন।
এখন আর সে সবের বালাই নেই। বারান্দার বাইরে এখন আলো আর আলো। তারই মাঝে নাচতে নাচতে চলেছে যুবক-যুবতীরা। বুঝি, রাসের আড়ম্বর-জৌলুস বেড়েছে। কিন্তু কমেছে ভক্তি। এই ৭৬ বছর বয়সে আজ মানুষের ভিড়ে সেই ভক্তিকেই খুঁজে ফেরে মন। |