|
|
|
|
|
শান্তির রাস শান্তিপুরে |
সুস্মিত হালদার |
রাসের রঙে...
|
রাস উৎসবের মানচিত্রে নদিয়ার শান্তিপুরের নাম বেশ উজ্জ্বল। ঐতিহ্যের দিক থেকে তো বটেই আড়ম্বর এবং জাঁকজমকের নিরিখেও এখানকার রাস ভক্ত ও দর্শকদের মন স্পর্শ করে যায়।
শান্তিপুরে রাসের প্রবর্তন অদ্বৈতাচার্যের হাত ধরে। তিনি ছিলেন শ্রীচৈতন্যের বড় ভাই বিশ্বরূপের অধ্যাপক। তবে চৈতন্যের সঙ্গেই তাঁর বেশি হৃদ্যতা ছিল। ১৪৩৪ সালে বর্তমান বাংলাদেশের লাউরে গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন অদ্বৈতাচার্য। মাত্র দশ বছর বয়সে নবদ্বীপে চলে এলেও পরের দিকে তিনি শান্তিপুরেই থাকতেন। যদিও শোনা যায়, মহাপ্রভুর সঙ্গে মতান্তরের কারণেই নাকি তাঁর পাকাপাকি ভাবে শান্তিপুরে চলে আসা।
রাসকে ঘিরে শান্তিপুরে নানা কাহিনি প্রচলিত। তার মধ্যে একটি তো লোকের মুখে মুখে ফেরে। এক বার, নিভৃতে গোপিনীদের সঙ্গে রাসে মগ্ন ছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। অন্য পুরুষের সেই অনুষ্ঠানে প্রবেশ নিষেধ। তবুও তার মধ্যে ছদ্মবেশে ঢুকে পড়েন শিব। আর সে কথা কী ভাবে যেন জেনেও গেলেন কৃষ্ণ। ব্যস, রাগ করে তিনি চলে গেলেন রাস প্রাঙ্গন ছেড়ে। সে বারের মতো বন্ধ হয়ে গেল রাস। কাজেই শিবের আর রাস দেখা হল না। চলে যাওয়ার আগে শিব বলে গেলেন, কৃষ্ণের রাস দেখতে না পাওয়ায় আফশোস থাকল। তবে মর্তে রাসকে অন্য রকম করে উপস্থাপন করে তিনি দেখিয়ে দেবেন। এর পরই নাকি শিবের অদ্বৈতাচার্য রূপে মর্তে আবির্ভাব। এই লোককথা মেনেও নিলেন অদ্বৈতাচার্যের বংশধর বড় গোস্বামীবাড়ির সত্যনারায়ণ গোস্বামী। তিনি বলেন, “আজও সকলে বিশ্বাস করেন, কৃষ্ণের রাস দেখতে না পেয়ে অদ্বৈতাচার্যের রূপ ধরে শিব শান্তিপুরে রাসের প্রবর্তন করেন। ক্রমশ সেই রাসই এখন সর্বজনীন চেহারা নিয়েছে।” |
বড় গোস্বামীবাড়ি রাসমঞ্চ |
|
|
রাসমঞ্চ |
বিগ্রহ |
|
শান্তিপুরে রাস শুরু হছে আগামী রবিবার। প্রায় দেড়শোটি রাসের মধ্যে ৩০টিই বিগ্রহ-বাড়ির। বিগ্রহ-বাড়ি অর্থাৎ যে পরিবারের স্থায়ী মন্দির ও বিগ্রহ আছে। আর বাকি সবই বারোয়ারি আয়োজন। তবে শান্তিপুরে ক্রমশ ‘থিম’-এর রাস জনপ্রিয় হচ্ছে। আপাতত সেই থিম নিয়েই উদ্যোক্তারা মেতে রয়েছেন লড়াইয়ে। বস্তুত, রাস উৎসবের তিনটি পর্যায়— বসা রাস, ভাঙা রাস ও কুঞ্জভাঙা। মূল রাসের অনুষ্ঠানকে ‘বসা রাস’ বলা হয়। বসা রাসের পর্ব মিটলে মঞ্চের বিগ্রহকে নিয়ে শোভাযাত্রার মাধ্যমে নগর পরিক্রমা করাকে বলা হয় ‘ভাঙা রাস’। তার পর রাসমঞ্চ থেকে মূল মন্দিরে বিগ্রহের ফিরে যাওয়াই ‘কুঞ্জভাঙা’। বিগ্রহ-বাড়ির ক্ষেত্রেই মূলত কুঞ্জভাঙা পর্ব দেখা যায়। কারণ বেশির ভাগ বারোয়ারি রাসেরই কোনও স্থায়ী মন্দির থাকে না।
শান্তিপুরে বিগ্রহ-বাড়ির রাসের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বড় গোস্বামীবাড়ি, পাগলা গোস্বামীবাড়ি, খাঁ চৌধুরীবাড়ি, মদন গোপাল গোস্বামীবাড়ি, চাকফেরা গোস্বামীবাড়ি, বাঁশবনিয়া গোস্বামীবাড়ি, হাটখোলা গোস্বামীবাড়ি, বংশীধারী জিউবাড়ি, কালাচাঁদ জিউবাড়ি, প্রামাণিকবাড়ি, আশানন্দবাড়ি, সাহাবাড়ি, দিনদয়ালবাড়ি, মঠবাড়ি, মহাভারত পোদ্দারবাড়ি প্রভৃতি। অন্য দিকে ‘বসা রাস’-এর জন্য বিখ্যাত বারোয়ারিগুলির মধ্যে বড় গোস্বামীপাড়া বারোয়ারি, ঠাকুরপাড়া যুবগোষ্ঠী, তামচিকাপাড়া আমরা সবাই, রামনগরপাড়া এসটিবি ইউথ ক্লাব, রামনগরপাড়া আদর্শ ক্লাব, তিলিপাড়া বারোয়ারি, ঘোষপাড়া যুবগোষ্ঠী, লক্ষ্মীতলা বারোয়ারি, সর্বানন্দীপাড়া বারোয়ারি, আগমেশ্বরীতলা ইয়ং স্টাফ, তারামা পুজো কমিটি, বউবাজার শ্যামচাঁদ রোড, শ্যামবাজার বারোয়ারি, বাইগাছিপাড়া সত্যনারায়ণ, ভদ্রাকালী, নবমিলন সংঘ, কালীয় দমন, অনন্ত শয্যায় নারায়ণ, ত্রিপদ নারায়ণ, পটেশ্বরী, তিলিপাড়া আমরা সবাই, সূর্য সঙ্ঘ, নেতাজি পল্লি, পঞ্চাননতলা ইয়ং স্টাফ, বাইগাছি পাড়া, অগ্রগামী পাড়া, খাঁপাড়া সুস্মিত স্মৃতি সঙ্ঘ, ভগবতী দাস রোড, যুবকবৃন্দ, চরজিজিরা যুবক সঙ্ঘ, ইউনাইটেড ত্রিবর্ণ ক্লাবের নাম উল্লেখযোগ্য। |
বিগ্রহ-বাড়ির রাসমঞ্চ |
|
|
মঠবাড়ি |
গোকুলচন্দ্রবাড়ি |
|
শুরু হওয়ার দু’দিন পর, অর্থাৎ এ বছর ১৯ নভেম্বর শান্তিপুরে ভাঙা রাস। রাসের এই পর্বটাও বসা রাসের মতোই সমান জনপ্রিয়। এই ভাঙা রাসের প্রবর্তনের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে এক কাহিনি।
পুরীর রাজা ইন্দ্রদুম্নের আমলে পূজিত দোলগোবিন্দের বিগ্রহটি যশোহরে নিয়ে এসেছিলেন বারো ভুঁইঞাদের অন্যতম প্রতাপাদিত্য। কিন্তু মানসিংহ বাংলা আক্রমণ করলে প্রতাপাদিত্য সেই বিগ্রহ তুলে দিয়েছিলেন মথুরেশ গোস্বামী নামে এক পণ্ডিতের হাতে। এই মথুরেশ গোস্বামী ছিলেন অদ্বৈতাচার্যের উত্তরপুরুষ এবং বারো ভুঁইঞাদের গুরু। তিনি সেই বিগ্রহ শান্তিপুরে নিয়ে এসে রাধারমণ জিউ নামে প্রতিষ্ঠা করেন। মথুরেশ গোস্বামী মারা যাওয়ার পর হঠাৎ এক দিন সেই বিগ্রহ চুরি হয়ে যায়। অনেক খোঁজাখুঁজির পর দিগনগরের একটি বিলে তার সন্ধান মেলে। সত্যনারায়ণবাবু জানিয়েছেন, “বিগ্রহ হারিয়ে যাওয়ার পর সকলের ধারণা হয়, যে হেতু কৃষ্ণ একা ছিলেন তাই তাঁর কষ্ট হচ্ছিল। এর পর এই পরিবারেরই একটি শাখা রাধিকা মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে। রাসের দিন সেই দুই মূর্তি মিলিত হয়।” আর এই যুগলমূর্তি শহরবাসীকে দেখাবার জন্যই শোভাযাত্রার আয়োজন করেছিল খাঁ চৌধুরী পরিবার। ভাঙা রাসের সেই সূচনা। ক্রমে বিভিন্ন বিগ্রহ-বাড়ির পাশাপাশি বারোয়ারিগুলিও এই ভাঙা রাসে অংশ নিতে থাকে। আর এখন তো এটাই শান্তিপুরে রাসের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ।
গত বছর প্রায় ৪২টি ভাঙা রাসের শোভাযাত্রা বের হয়েছিল। যদিও সব রাস কমিটি ভাঙা রাসে অংশ নেয় না। বিভিন্ন বিগ্রহ-বাড়ির পাশাপাশি নতুনপাড়া অভিযাত্রী সংঘ, ভারত মাতা ক্লাব, ত্রিকোণ পার্ক, বেজপাড়া কমলা কলোনি, এবিসিডি ক্লাব, সর্বানন্দীপাড়া বারোয়ারি, লেবুতলা বারোয়ারি, ষষ্ঠীতলা বারোয়ারি, ওড়িয়া গোস্বামীপাড়া বারোয়ারির মতো বেশ কিছু বারোয়ারি ভাঙা রাসে রীতিমতো জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। ভাঙা রাসে শোভাযাত্রা সহযোগে প্রত্যেকেই তাদের বিগ্রহ নিয়ে শহর পরিক্রমা করে। আর সেই পরিক্রমা দেখতে গভীর রাত পর্যন্ত রাস্তার দু’পাশে দাঁড়িয়ে থাকেন হাজার হাজার মানুষ। গোটা শান্তিপুর যেন ভেসে যায় জনসমুদ্রে। |
ভাঙারাসের শোভাযাত্রা |
ভাঙা রাসের পর দিন বিকেলে অনুষ্ঠিত হয় ‘কুঞ্জভাঙা’। এ দিনও হাজার হাজার ভক্ত বিগ্রহ-বাড়িগুলিতে হাজির হন।
শান্তিপুরে রাস দেখতে এসে রাতে থাকার বিশেষ কোনও ব্যবস্থা নেই। পুরসভার একটি গেস্ট হাউস ছাড়া কয়েকটি মাত্র ছোট হোটেল থাকলেও তা অনেক দিন আগে থেকেই ‘বুক’ হয়ে যায়। তবে সারা রাত মানুষের ভিড়ে ঘুরে রাস দেখার সময় এক বারও রাতে হোটেলে থাকার কথা মনে হবে না। |
ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য |
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|