একটা সময় ছিল যখন রাসমেলার গন্ডি মদনমোহন মন্দির লাগোয়া বৈরাগী দিঘির চারদিকের এলাকা ঘিরে বসা অল্প কিছু দোকানপাট নিয়ে সীমাবদ্ধ ছিল। তাতে অবশ্য কলকাতার কিছু দোকানও থাকত। মন্দির চত্বরের সং-পুতুল ছিল মেলার অন্যতম আকর্ষণ। এক বার ওই সং পুতুল দেখতে এসেছিলেন খোদ মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ। দুই ভাগ্নে ভীম ও ভরতকে সঙ্গে নিয়ে। আজ
৮৩ বছর বয়সে দাঁড়িয়েও ওই ছবিটা ভুলতে পারি না। ফি বছর ওই সব পুতুল পরিবর্তন করা হতো। তাতে কখনও ব্যবসায়ী, কখনও আইনজীবী বা অন্য কিছুর মডেল উঠে আসত। এখনও ওই সব সং পুতুল থাকে, তবে ফি বছরের মতো পুরোপুরি নতুনত্ব কিছু দেখা যায় না। সময়ের প্রবাহে মেলার গণ্ডি আজকের রাসমেলা মাঠের বিশাল এলাকা তো বটেই, লাগোয়া রাস্তাজুড়েও ছড়িয়েছে। মেলার সময়সীমা তিন দিন, সাত দিন, দশ দিন থেকে বাড়তে বাড়তে পনেরো দিনে দাঁড়িয়েছে। অসংখ্য দোকানপাট-নাগরদোলা-সার্কাস-মৃত্যুকূপ, আরও কত কিছু মেলার আকর্ষণ বাড়িয়েছে।
বদলেছে মেলার দর্শনার্থীদের যানবাহন থেকে রাত্রিবাসের ব্যবস্থাও। আমি নিজে ছোটবেলায় দেখেছি কোচবিহারের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে গরুর গাড়ি চেপে মানুষজন মেলা দেখতে আসতেন। দলসিংপাড়া থেকে লালমণিরহাটের বিশেষ ট্রেনেও অনেকে আসতেন। মেলা ঘুরে তাদের বেশির ভাগই থাকতেন রাতভর যাত্রাপালা দেখতে। সকালে মুখিয়ে থাকতেন ভাগবতপাঠ শুনতে। এমনকী, খোদ মহারাজারাও তাতে সামিল হতেন। রাজবাড়ি থেকে আনা সোফায় বসে মহারাজা অন্য দশ জনের সঙ্গে ভাগবতপাঠ শুনেছেন। এখন সে সব ইতিহাস! মেলা মানেই গাড়ি-মোটরবাইক-সাইকেলের ছড়াছড়ি। যাত্রাপালা ও কীর্তন অবশ্য এখনও হয়। দর্শনার্থীদের কেউ কেউ মদনমোহন মন্দিরের কাছে আনন্দময়ী ধর্মশালাতেও থাকেন। তবে অতীতের সেই ছবিটার সঙ্গে বর্তমানের ফারাক অনেক। |
সে কালের সেই ‘সর্ণা প্রথা’ও উঠে গিয়েছে। আগে রাসমেলার সময় একটা দিন মদনমোহন মন্দির চত্বরে মহিলাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। দেবোত্তর ট্রাস্টি বোর্ডের কর্মী ও আধিকারিকরা ছাড়া সে দিন বাইরের পুরুষদের সেখানে প্রবেশাধিকার ছিল না। রাজার প্রহরীরা ওই দিনটা বিশেষ ভাবে নজর রাখতেন। রাসমেলা ঘিরে নিরাপত্তার কড়াকড়ি ছিল, তবে এখনকার মতো এতটা নয়।
রাজ-আমলের রাস উৎসবের সূচনার সঙ্গে এখনকার সূচনার ফারাকটা অবশ্য আমার চোখে কিছুটা বিস্ময়কর। তখন মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণকে দেখেছি রাজপুরোহিত চারুকেশ চক্রবর্তীর পাশে দাঁড়িয়ে পুজোর ফুল হাতে নিয়ে অঞ্জলি দিয়ে রাসচক্র ঘোরাতেন। পুরোহিতের পাশে বসে মহারাজা পুজো করতেন না। রাজ আমলের অবসানের পর জেলাশাসকরা রাসচক্র ঘুরিয়ে উৎসবের সূচনা করেন, তাও আবার পুরোহিতের পাশে বসে মন্ত্রোচ্চারণ করে পুজো সম্পন্ন করার পর।
আরও একটা বিষয় মনে আছে— উৎসবের সূচনার পর মহারাজাকে দেখেছি দেবতার উদ্দেশে ১৪ টাকা করে প্রণামী দিতেন। মদনমোহন, ভবানী, তারা, কালীমন্দির ঘুরে ঘুরে তিনি ওই প্রণামী দিয়েছেন। মহারানিকে একই ভাবে প্রণামী দিতে দেখেছি। তবে মেলা ঘুরে কোনও মহারাজাকে কখনও কেনাকাটা করতে দেখিনি।
মেলায় জিলিপি টমটম গাড়ির চাহিদা আগের মতোই রয়েছে। তবে অতীতের মেলায় অস্থায়ী সিনেমা হল করে ছবি প্রদর্শনটা অন্য অনেক কিছুর মতই হারিয়ে গিয়েছে। |